গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে ইসরায়েল ও হামাস
১৫ মাস ধরে চলা সংঘাতের অবসান ঘটাতে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে বলে কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীরা জানিয়েছে। খবর বিবিসি'র।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি জানিয়েছেন, ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা চুক্তিটি অনুমোদন করলে এটি রোববার থেকে কার্যকর হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, "এই চুক্তি গাজায় সংঘর্ষ থামাবে, ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করবে এবং জিম্মিদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেবে।"
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, চুক্তির চূড়ান্ত কিছু বিষয় এখনও কাজ চলছে। তবে তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এই চুক্তির "প্রসার ঘটানো"র জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
অন্যদিকে, হামাস নেতা খালিল আল-হাইয়া বলেছেন, এটি ফিলিস্তিনিদের "অদম্য সহনশীলতার" ফল।
এই চুক্তির খবরে অনেক ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবার আনন্দ প্রকাশ করেছে। তবে গাজার মাটিতে যুদ্ধের তীব্রতা এখনও কমেনি।
কাতারের ঘোষণার পরপরই ইসরায়েলি বিমান হামলায় ২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি। তবে এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কোনো মন্তব্য করেনি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে ইসরায়েলে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হয় ও ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংসের জন্য গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে গাজায় ৪৬ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ২৩ লাখ মানুষের অধিকাংশই বাস্তুহারা হয়েছেন। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও আবাসনের মারাত্মক সংকট দেখা গিয়েছে। মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
ইসরায়েল জানিয়েছে, হামাস এখনো ৯৪ জন জিম্মিকে আটক করে রেখেছে। তাদের মধ্যে ৩৪ জনকে মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া, যুদ্ধের আগেই অপহৃত চার ইসরায়েলির মধ্যে দুইজন মারা গিয়েছিলেন।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী আল থানি দুই পক্ষের প্রতি "শান্ত থাকার" আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ছয় সপ্তাহে ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে [যার মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রয়েছেন] ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হবে।
ইসরায়েলি বাহিনী গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে পূর্ব দিকে সরে যাবে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা ঘরে ফিরে যেতে পারবেন এবং প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি পাবে।
যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনাগুলো ১৬তম দিনে শুরু হবে। এই ধাপে বাকি জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং "স্থায়ী শান্তি" প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।
তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপে গাজার পুনর্গঠন এবং যেকোনো জিম্মির মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার কাজ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে গাজার পুনর্গঠন সম্পন্ন হতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
আল থানি জানিয়েছেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের আলোচনার জন্য একটি "পরিষ্কার পদ্ধতি" নির্ধারণ করা হয়েছে। চুক্তির বিস্তারিত আগামী কয়েক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত করে প্রকাশ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিশর যৌথভাবে ইসরায়েল ও হামাসকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার জন্য কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রী আল থানি বলেন, "আমরা আশা করি, এটি হবে যুদ্ধের শেষ অধ্যায়। এবং আমরা প্রত্যাশা করি, সব পক্ষ এই চুক্তির শর্তগুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।"
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আট মাস আগে তৈরি করা পরিকল্পনার ফলাফল হিসেবে এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, "হামাসের ওপর তীব্র চাপ, লেবাননে যুদ্ধবিরতি ও ইরানের দুর্বলতার পাশাপাশি মার্কিন কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।"
বাইডেন হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণে নিহতদের এবং যুদ্ধের ফলে মারা যাওয়া নিরীহ মানুষদের স্মরণ করেন। তিনি জানান, "যুদ্ধ বন্ধ করার সময় দীর্ঘদিন আগে পেরিয়ে গেছে। এখন শান্তি ও নিরাপত্তা গড়ে তোলার কাজ শুরু করার সময়।"
পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহযোগিতার প্রশংসা করেন। ট্রাম্প নিজের অভিষেকের আগে উভয় পক্ষের ওপর জিম্মিদের মুক্তির জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। বাইডেন জানান, "শেষ কয়েক দিনে আমরা এক দল হিসেবে কাজ করেছি।"
চুক্তি কার্যকর হওয়ার বেশিরভাগ কাজ বাইডেনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর হবে।
কাতার ও হোয়াইট হাউজের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই ট্রাম্প প্রথমে চুক্তির খবর নিশ্চিত করেন। পরে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই "ঐতিহাসিক চুক্তি"র জন্য কৃতিত্ব দাবি করে বলেন, "নভেম্বরে আমাদের ঐতিহাসিক বিজয়ের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।"
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, চুক্তি চূড়ান্ত করতে বিস্তারিত কাজ চলছে এবং সরকারি বিবৃতি "তখনই প্রকাশ করা হবে, যখন চূড়ান্ত বিষয়গুলি সম্পন্ন হবে।"
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হেরজোগ বলেন, চুক্তিটি "গভীর বেদনা" এবং "তীব্র চ্যালেঞ্জ" নিয়ে আসবে, তবে এটি "সঠিক পদক্ষেপ"।
চুক্তিটি ইসরায়েলি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হওয়ার আশা রয়েছে, সম্ভবত বৃহস্পতিবার সকালে। তবে, নেতানিয়াহুর ডানপন্থি জোটের চুক্তির প্রতি বিরোধিতা রয়েছে।
চুক্তি অনুমোদন পেলেই মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দিদের নাম ইসরায়েলি সরকার প্রকাশ করবে। এছাড়া, ভুক্তভোগী পরিবারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে আপিল করার জন্য। কিছু ফিলিস্তিনি বন্দি হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ইসরায়েলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন।
হামাসের প্রধান মধ্যস্ততাকারী ও গাজার ভারপ্রাপ্ত প্রধান খলিল আল-হাইয়া বলেছেন, চুক্তিটি "শত্রুর সাথে সংঘর্ষে একটি মাইলফলক" এবং এটি তাদের জনগণের মুক্তি ও ফেরার লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ।
তিনি আরও বলেন, "আমরা গাজাকে পুনর্গঠন করতে চাই, ব্যথা কমাতে এবং ক্ষত সারাতে চাই।" তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় ফিলিস্তিনিদের যে কষ্ট হয়েছে তা "আমরা ভুলব না এবং আমরা ক্ষমা করব না" ।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, "এই সংঘাতের কারণে তৈরি হওয়া ভয়াবহ ভোগান্তি কমানোই এখনকার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।"