চিনি শিল্প করপোরেশনের আর্থিক অব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংককে যেভাবে সমস্যায় ফেলছে
আর্থিক অব্যবস্থাপনার কথা উঠলে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) কথা; সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করতে পারে— এটি তেমনই উদাহরণ।
বিএসএফআইসি'র কাছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাছে অনাদায়ী ঋণ ১০ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির কারণে বছরের পর বছর ধরে অশ্রেণীকৃত অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়, কিন্তু সেই গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপরেও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণগুলোকে অশ্রেণীকৃত হিসেবে রিপোর্ট করেছে ব্যাংকগুলো। এই ঘটনা নজরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের কাছে এর ব্যাখ্যা তলব করে জানতে চেয়েছে: রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মেয়াদ এক বছর আগে শেষ হলেও কেন এসব ঋণকে খেলাপি বা এনপিএল হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, এ ধরনের পদক্ষেপের মারাত্মক প্রভাব পড়তো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যে।
১০,৫১৮ কোটি টাকাকে যদি খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হলে— ব্যাংকগুলোকে ঋণগুলোর বিপরীতে বিপুল পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হতো – যা তাদের সক্ষমতার বাইরে। ২০২৩ সালে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক মোট মুনাফা করেছে ৯৭৪ কোটি টাকা। এই অবস্থায়, বিএসএফআইসির ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে— তাদের একই হারে ১১ বছরের বেশি সময়ের মুনাফা লাগত। আর এই সময়ের মধ্যে তারা অন্য গ্রাহককে ঋণও দিতে পারতো না।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে এই হিসাবের মধ্যে আনা হলে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় দেখায়। কারণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২,৩০০ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে কৃষি ব্যাংক। ফলে এই লোকসানকে ধরে হিসাবের আঁক টানলে— অন্য চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মুনাফা আর থাকে না, সম্মিলিতভাবে তা লোকসানে দাঁড়ায়। বিএসএফআইসির ঋণকে খেলাপি বা মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীকরণের এই মারাত্মক পরিণাম এভাবেই উঠে আসছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, ঠিক একারণেই ব্যাংকগুলো বিএসএফআইসি'কে খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করতে চায়নি। কিন্তু, রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি নবায়ন না হওয়ায়— বাংলাদেশ ব্যাংককে বাধ্য হয়ে ব্যাখ্যা চাইতে হয়েছে। আর তাতে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে, তা এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে চলেছে।
এখনও সে টানাপোড়েন চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সমস্যাটি রয়েছে পদ্ধতিগত ত্রুটির গভীরে— যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে, এবং দেশের সম্পূর্ণ আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাঁরা বলছেন, বন্ড ইস্যু করে কিংবা গ্যারান্টি দিলেও চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বিপুল দেনার দায় সরকারের কাঁধেই থাকছে।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'এভাবে সরকার থেকে সহায়তা দেওয়া বটমলেস বাস্কেট (তলাবিহীন ঝুড়ি) এর মতো। কারখানাগুলোকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। এগুলোকে এভাবে রেখে দেওয়ার কোন মানে হয় না। তাই চিনিকলগুলোকে হয় লিকুইডেটেড (অবসায়িত) করে ফেলতে হবে, না হয় বেসরকারিখাতে বিক্রি করে দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'সরকারি মিলগুলোকে বারবার সরকারি সহযোগিতায় সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক মডেল পরিবর্তন করে মিলগুলোকে করপোরেশন করা হলেও ম্যানেজমেন্ট কালচারে কোন পরিবর্তন হয়নি। এখনও আগের মতোই রিটায়ার্ড আর্মি বা সিভিল সার্ভেন্ট দিয়েই করপোরেশনগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এসব করপোরেশনের পারফরম্যান্সে কোন উন্নতি নেই।'
জাহিদ হোসেন বলেন, আদমজী পাটকল বন্ধ করার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যেভাবে প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে, চিনিকলগুলোর শ্রমিকদের জন্যও একই ধরণের প্যাকেজ দেওয়া যেতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট নথি অনুযায়ী, বিএসএফআইসি'র অধীনে ১৫টি চিনিকল রয়েছে, যার বেশিরভাগই বর্তমানে উৎপাদন করছে না। বিক্রয়মূল্য অপেক্ষা উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায়– চিনিকলগুলো ক্রমাগত লোকসান বহন করছে। মূলত মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও আখ কেনাবেচায় বড় ধরণের অনিয়মের কারণে এসব চিনিকলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসএফআইসি ৫৭১ কোটি টাকা পরিচালনগত লোকসানের তথ্য জানিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ২৯০ কোটি টাকা লোকসানের প্রক্ষেপণ রয়েছে। এছাড়া, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে করপোরেশনটির দেনা বনাম সম্পদের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১৮০:৮০'তে। অর্থাৎ, প্রতি ৮০ টাকা সম্পদের বিপরীতে বিএসএফআইসির দেনা হলো ১৮০ টাকা। চিনিকল পরিচালনা করতে ঋণের ওপর চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অতি-নির্ভরতাকেই তুলে ধরে এমন উচ্চ অনুপাত।
বিএসএফআইসি'কে দেওয়া রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর চিঠিতে যা বলা হয়েছে
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যানের কাছে গত তিন সপ্তাহে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা পৃথকভাবে চিঠি লিখে এই ঋণ অস্বস্তির কথা তুলে ধরেছেন।
চিঠিগুলোয় ব্যাংকগুলোর সিইও এবং এমডিরা লিখেছেন, ঋণের বিপরীতে সরকারের গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর – গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধি বা নবায়ন করা, অথবা দায় পরিশোধের জন্য অনুরোধ জানিয়ে—- একাধিকবার চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হলেও – ঋণ হিসাবে কোন টাকা পরিশোধ করা হয়নি, গ্যারান্টির মেয়াদও বাড়ানো হয়নি। এই সময়ে, বন্ড ইস্যুকরণের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে অর্থবিভাগকে বারবার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোন সাড়া মেলেনি।
ব্যাংকগুলো বলেছে, এসব ঋণ পরিশোধ না হওয়ার কারণে তাদের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে, যা ব্যাংকের মুনাফাযোগ্যতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং মূলধন ঘাটতির অবনতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনামের যে ক্ষতি হচ্ছে, তাতে বৈশ্বিক লেনদেন বা বাণিজ্যে তাদের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন, ঋণ হিসাবগুলো সমন্বয় বা নিয়মিত করা হলে ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ হ্রাস পাবে, প্রভিশন ঘাটতি কমবে এবং মূলধন ঘাটতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঋণগুলো নিয়মিত হলে ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং ও ক্যামেলস রেটিংয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যয় হ্রাস পাবে।
ব্যাংকগুলো তাদের দেওয়া ঋণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুদসহ ফেরত চেয়েছে। যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাহলে ঋণের বিপরীতে দেওয়া রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মেয়াদ বৃদ্ধি অথবা বন্ড ইস্যু করা, অথবা অন্য কোন বিকল্প পদ্ধতিতে ব্যাংকের দায় পরিশোধ করার অনুরোধ করেছেন ব্যাংকগুলোর এমডি ও সিইওরা।
বিএসএফআইসি যা বলছে
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পর, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্র গত ২৩ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়ে ব্যাংকগুলোর ঋণের বিপরীতে ট্রেজারি বিল ইস্যু করার অনুরোধ জানিয়েছেন। আর ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা সম্পন্ন হওয়ার আগপর্যন্ত—- ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণ ও মূলধন ঘাটতি থেকে রক্ষা করতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি ইস্যু করতে অনুরোধ জানান তিনি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বকেয়া ঋণ পরিশোধে অতীতে সরকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করেছে। একইভাবে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের দেনা পরিশোধেও ব্যাংকগুলোর বিপরীতে বন্ড ইস্যু করতে সরকারকে অনুরোধ করেছেন ড. লিপিকা ভদ্র।
অর্থবিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বকেয়া টাকার বিপরীতে ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা এবং রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত নির্ধারণে–- গত ৩১ ডিসেম্বর অর্থসচিবকে চিঠি দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলো ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিচ্ছে কেন?
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্র চিঠিতে লিখেছেন, বিএসএফআইসি ও তার আওতাধীন চিনিকলগুলোর বিভিন্ন ঋণ দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচালিত হচ্ছে। শুরুর দিকে নিয়মিতভাবে ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ করা হলেও— সরকার থেকে সময়মত ব্যবসায়িক ঘাটতি ও ভর্তুকির টাকা না পাওয়ায় আর্থিক সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঋণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বিক্রয় মূল্য অপেক্ষা উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায়— চিনিকলগুলো ক্রমাগত লোকসান বহন করছে। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ চক্রবৃদ্ধিহারে যুক্ত হওয়ায়, বছর বছর লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে। এত বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক অবস্থায় যেতে পারছে না।
সূত্রগুলো জানায়, সরকারি মিলগুলোতে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন ব্যয় ৩০০ টাকারও বেশি, যা বাজারে চিনির সর্বোচ্চ দাম ১৪০ টাকার চেয়েও অনেক বেশি।
এসব চিনিকলসহ রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানী কারখানাগুলো চালু রাখার বদলে বন্ধ করে দিতে ২০১৫ সালে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে চিঠি দিয়েছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
চিঠিতে মুহিত লিখেছিলেন, যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারি সহায়তায় চালু হয়েছে— সেগুলোর একটিও লাভের মুখ দেখেনি। বরং দিনের পর দিন সরকারি সহায়তায় টিকে আছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই অবস্থায় নতুন করে কোন বন্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হলে— অর্থমন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা দেওয়া হবে না।