বিদেশি ব্রান্ডের মধু কি আস্থার যোগ্য?
মধু একটি পুষ্টিকর ও উপাদেয় খাবার। সুস্বাস্থ্য বিবেচনায় পথ্য হিসেবেও এর ব্যবহার সমাদৃত। এই জনপ্রিয়তার কারণে দেশের বাজারে হরেক রকমের দেশি-বিদেশি মধু পাওয়া যায়। খাঁটি দেশি মধুর নামে জালিয়াতির কথা গণমাধ্যমের আলোচনায় এলেও নামিদামি বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো সমালোচনার ঊর্দ্ধে।
রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় কেনাকাটা করতে এসেছিলেন কর্মজীবী গৃহবধূ রোকসানা আনসারি। এপ্রসঙ্গে কথা হলো তার সঙ্গে। রোকসানা বলেন, 'বাসায় সবাই মধুর ভক্ত। তাই আমি সাধারণত একটু বেশি পরিমাণে দেশি মধু কিনি। বিদেশি ব্রান্ডের দাম একটু বেশি, তাই বেশি পরিমাণে কেনাটা ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠে না।'
বিদেশি ব্রান্ডে তার যে বেশি আস্থা আছে সেকথাও জানান তিনি। শুধু তিনি একাই নন, রাজধানীর গুলশান-বনানী-সহ প্রায় সব এলাকায় অভিজাত সুপারমার্কেটগুলোতে রমরমা বিকিকিনি হয় বিদেশি মধু। থরে থরে সাজানো এই পণ্য সমাহারের জালিয়াতি ধরা পড়েছে খোদ যুক্তরাজ্যেই।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ডেইলি মেইল জানায়, ব্রিটেনের বড় সুপারমার্কেটগুলোর শেলফে মধুর পরিবর্তে সস্তা চিনির সিরাপ পাওয়া গেছে। আজ রোববার (২২ নভেম্বর) এক অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে এ তথ্য তুলে ধরে গণমাধ্যমটি।
ব্রিটেনের তিনটি বড় সুপারশপ চেইন হচ্ছে; টেসকো, সেইন্সবেরি ও আসডা। ল্যাবরেটরীতে করা পরীক্ষায় তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই বিপণীকেন্দ্রে চাল আর ভুট্টা থেকে তৈরি চিনির সস্তা দ্রবণ পাওয়া গেছে নামিদামি ব্রান্ডের মধুর কৌটায়।
'নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স টেস্ট' নামক সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই পরীক্ষার এই ফলাফল চাঞ্চল্য তৈরি করেছে যুক্তরাজ্য জুড়ে। ২০১৩ সালের ঘোড়ার মাংস নিয়ে কেলেঙ্কারির পর এই প্রথম খাদ্য নিয়ে এত বড় জালিয়াতি ধরা পড়লো।
সেই সূত্রে দেখা যাচ্ছে, মৌচাক থেকে নয় বরং এসব পণ্যের উৎস হচ্ছে আসলে কারখানা। দেশটির মধু আমদানিকারক এবং সুপারমার্কেট চেইনগুলো অবশ্য এই ফলাফল অস্বীকার করে বলেছে, পরীক্ষাটি ত্রুটিপূর্ণ এবং এর ফলাফল বিশ্বাসযোগ্য নয়।
তবে এনিয়ে বিতর্কের জেরে গতকাল রাতেই খাদ্য বিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এক বৈঠক করে। মান বিচারে সেখানে একটি জাতীয় পরীক্ষা পদ্ধতি চালুর প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য প্রতিবছর ৫০ হাজার টন মধু আমদানি করে। চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ যোগান দেয় চীন। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরেই ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত নানা দেশের চাষিদের অভিযোগ; প্রতি কিলো মধু উৎপাদনে তাদের সাড়ে তিন পাউন্ড খরচ হয়। সেখানে চীন কিভাবে তা নূন্যতম ১.১০ পাউন্ডে সরবরাহ করছে- তা যাচাই করে দেখা উচিৎ।
ইউরোপীয় চাষিদের জোট কোপা-কোগেচার এক সদস্য ইতিনে ব্রুনেও অভিযোগ করেন, 'মধুর কৌটায় শুধুমাত্র বেশি করে চিনির দ্রবণ মেশালেই এত কম দামে বিক্রি করা সম্ভব।'
এমন অভিযোগের কারণেই গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যের সুপারমার্কেটগুলোর নিজস্ব ব্রান্ডের মধুর মান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে হানি অথেনটিসিটি প্রজেক্ট। এসব মধু আমদানি করা নয়, বরং যুক্তরাজ্যে উৎপাদিত। তাই ফলাফল সকলকে বিস্মিত করেছে।
জার্মানির ফুডকিউএস নামক একটি ল্যাবরেটরিতে মত ১৩টি ব্রান্ডের মধু ২৪০ বারের বেশি পরীক্ষা করা হয়। সেখানে টেসকোর সমবায় ভিত্তিক মধু ব্র্যান্ড ক্লিয়ার হানির ৪৫৪ গ্রামের কৌটায় পাওয়া গেছে স্পিকোজ নামে এক ধরনের চিনির মিশ্রণ। প্রাকৃতিক মধুতে এমন কোনো চিনি থাকে না। এর ফলে মধুতে সিরাপ মেশানো হয়েছে এমন প্রমাণ মেলে।
আসডার পিওর হানি এবং সেইন্সবেরির ক্লিয়ার হানি-সহ মোট ১০টি ব্র্যান্ডের মধুতেও পাওয়া গেছে বিশেষ ধরনের এনজাইম, যা শুধুমাত্র চিনির দ্রবণ মেশালেই মধুতে থাকা সম্ভব।
ফলাফলের প্রসঙ্গে ফুডকিউএস- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বের্ন্ড ক্যাম্ফ বলেন, ''প্রত্যেকটি ব্রান্ডের পণ্যেই একাধিক দ্রবণ মেশানোর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক ধাপে এসব চিনির সিরাপ যোগ করে ভেজাল দেওয়া হয়েছে।''
এব্যাপারে কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্ট- এর ইনস্টিটিউড ফর গ্লোবাল ফুড সেফটি'র পরিচালক অধ্যাপক ক্রিস এলিওট জানান, ''মধুতে ভেজাল দেওয়া খাবারের দুনিয়ায় অন্যতম এক বড় বাণিজ্য। বড় সুপারমার্কেটগুলো আসল পণ্য পরীক্ষায় কিছু পরীক্ষা করে বটে, কিন্তু তাদের বাইরে অন্যান্য বিপণীকেন্দ্রে দেদারসে বিকোচ্ছে ভেজাল মধু।''
বিখ্যাত সুপারশপগুলোর নিজস্ব ব্রান্ডের মধুতে ভেজাল পাওয়ার ঘটনাকে তিনি মারাত্মক হুমকি বলে উল্লেখ করেন।
- সূত্র: ডেইলি মেইল