আন্তর্জাতিক প্রসাধনী ব্র্যান্ডগুলো নারী নিগ্রহ ও দাসত্বের সঙ্গে জড়িত!
হোক সে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য, প্রসাধনী, ওষুধ, জ্বালানি বা ভোজ্য তেল- আধুনিক বিশ্বে হাজারো ধরনের পণ্যে ব্যবহৃত হয় পামওয়েল। পাম চাষের বিকাশ আর শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কোম্পানি স্বার্থের ইন্ধনে চিরসবুজ বনভূমি ধবংসের কথা বহুদিন থেকেই জানেন অনেকে। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বরাতে পাম বাগানে দাস প্রথায় বন্দি লোকদের কথাও জানা গেছে।
অনুসন্ধানী ওই প্রতিবেদনটি করেছিল বার্তা সংস্থা এপি। সেখানে মানব পাচারের সঙ্গে এই আধুনিক দাসত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তুলে ধরা হয়। ওই অনুসন্ধানের আরেকটি পর্বে এবার স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক প্রসাধন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা পাম বাগানে নারীদের ভয়াবহ মাত্রায় নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে।
পৃথিবীর সিংহভাগ পাম চাষ হয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়। পরস্পরের প্রতিবেশী এ দুই দেশে হাজারো নারীর জীবন ধ্বংসের কারণ হয়েছে ধর্ষণ ও শ্রম শোষণ। ১৬ বছরের এক কিশোরীর দেখা পান, এপি'র সংবাদদাতা। ওই কিশোরীকে ধারালো কুড়াল দিয়ে ভয় দেখিয়ে মুখ চেপে নির্যাতন করে কর্মীদলের সুপারভাইজার। শেষে কাউকে না বলার জন্যেও শাসায়।
আরেকটি বাগানে ওলা নামের এক ভীষণ অসুস্থ নারীর দেখা মেলে। তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর, ঘন ঘন কাশছিলেন আর তার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গর্ভবতী ওলা আসলে শ্রম শোষণের শিকার। মাস্ক বা কোনো প্রকার সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই তাকে দিনের পর দিন মারাত্মক বিষাক্ত সব কীটনাশক ছিটাতে বাধ্য করা হয়। অসুস্থ হওয়ার পর কেউ তার খোঁজ নেয়নি। দিনে মাত্র দুই ডলারের নিচে আয় করা এ নারীর চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আর্থিক সঙ্গতিও নেই।
শত শত মাইল দূরের আরেক পাম বাগানে নিজের দুই শিশুকে হারিয়ে কাঁদছিলেন ইটা নামের এক তরুণী গৃহবধূ। যমজ বাচ্চা গর্ভধারণ করা অবস্থায় তিনি নিজের চাইতেও ভারি বোঝা টেনেছেন পাম বাগানে। না হলে চাকরিচ্যুতির ভয় দেখানো হয়।
পাম শিল্পে জড়িত এবং অবহেলিত এই তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা প্রায় অদৃশ্য। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়াজুড়ে এমন লাখ লাখ কন্যা, মা আর তাদের মাতামহী এই শোষণ আর নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছেন। অথচ তাদের রক্তঘাম করা পরিশ্রমেই উৎপাদন করা সম্ভব হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভেজিটেবল ওয়েল।
প্রসাধনী শিল্পের বিখ্যাত কিছু ব্র্যান্ড ল'রিয়েল, ইউনিলিভার, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, অ্যাভন, জনসন অ্যান্ড জনসনের মতো কোম্পানি বিশ্বজুড়ে নারীদের সুন্দর রাখার জন্য প্রসাধনী বিক্রি করে। বাৎসরিক বাণিজ্য ৫৩ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু, তাদের প্রায় সকল পণ্যের অন্যতম উপকরণ পামওয়েল থেকে সংগৃহীত উপাদান।
অর্থাৎ, আপনি হয়তো প্রিয় ব্রান্ডের প্রসাধনী কিনে নারী নির্যাতনকে প্রতিনিয়ত উস্কে দিচ্ছেন নিজের অজান্তেই।
এপি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাম শিল্পে সবচেয়ে বেশি কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নারীদের দিয়েই করানো হয়। এরমধ্যে রয়েছে তেজস্ক্রিয় কীটনাশক ছিটানো বা ভারি বোঝা টানা। বোঝা এত ভারি হয় তাতে যেকোনো গর্ভবতী নারীর অকাল গর্ভপাত হতে পারে।
অনেক নারীকে আবার সহকারী ঠিকাদারদের মাধ্যমে ভাড়া করে বাগানের মালিকানা কোম্পানি। দৈনিক মজুরির শর্তে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য করা হয় তাদের। অনেককেই এমন কাজ করছেন কয়েক দশক ধরে। তবু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিপত্তি এড়াতে তাদের স্থায়ী কর্মী করা হয়নি। এতটাই অমানবিক এবং মুনাফা লোভি এই শিল্প।
ইউনিলিভারের মতো অনেক প্রসাধনী কোম্পানি আবার অনেক বাগানেরও মালিক।
মজুরির শর্ত দেওয়া হলেও, আবার অধিকাংশ দিনেই মেলে না প্রতিশ্রুত অর্থ। এসব নারীর স্বামীরাও পাম বাগানে কাজ করেন। তাদের চাকরির শর্ত হিসেবে দৈনিক পরিশ্রমের যে অসম্ভব শর্ত সুপারভাইজাররা বেঁধে দেয়- তা পূরণে সাহায্য করতেই কাজ করেন স্ত্রীরা।
দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় এনজিও'গুলো এসব নিয়ে অভিযোগ করে আসলেও- তা কেউ পাত্তা দেয়নি। কারণ, আন্তর্জাতিক কোম্পানি আর তাদের স্বার্থ রক্ষায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া দুই দেশের রাজনীতিবিদেরাই আপ্রাণ চেষ্টা করে।
ইন্দোনেশিয়া ভিত্তিক এমন একটি অলাভজনক সংস্থা সাউইত ওয়াচের এক মুখপাত্র হোল্টার প্যারাসাওরা অভিযোগ করেন, ''সবকটি বাগানে শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে অন্যায় করা হচ্ছে। কিন্তু, নারী শ্রমিকদের দশা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি শোচনীয়।''
তার মতে, সরকার, পাম চাষি, বড় আন্তর্জাতিক ক্রেতা এবং ব্যাংকিং গোষ্ঠী এই ব্যবসার সুফলভোগী আর বড় বিনিয়োগকারী। কিন্তু, শ্রমিক নির্যাতন বন্ধে তাদের উদ্যোগ লোক দেখানো পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। তিনি পামতেল থেকে তৈরি ২০০টি উপাদানের কথাও জানান। বিশ্বের প্রতি তিন-চতুর্থাংশ রূপ চর্চা পণ্যে এসব উপাদান ব্যবহৃত হয়। যার মধ্যে মাসকারা থেকে শুরু করে ত্বক কুচকানো ঠেকানোর ক্রিম প্রায় সবকিছুই আছে।
বিশ্বব্যাপী নারী মুক্তির বিজ্ঞাপন নিয়ে মাতোয়ারা হলেও, পাম বাগান থেকে কিন্তু কোম্পানিগুলো সস্তা উপাদান পেতেই আগ্রহী। তাই কয়েক দশক ধরে চলে আসা নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, এমনটাই প্রমাণিত হয় এপির অনুসন্ধানে। এজন্য এপি যৌন নির্যাতন ও শ্রম শোষণের শিকার ১২ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেয়।
- সূত্র: এপি