ওয়ারী ক্লাব: ক্যাসিনোর আবর্তে হারিয়ে গেল গৌরবের অতীত
ওয়ারী ক্লাবের বয়স একশ’ বছরেরও বেশি। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা স্পোর্টিং ক্লাব হিসেবে শতবর্ষের এ সময়ের বেশিরভাগটা জুড়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ছিল ক্লাবটি।
১৮৯৮ সালের কথা। তখনও এদেশে চলছে ব্রিটিশ শাসন। ওয়েলিংটনে ক্লাব বন্ধ হয়ে যাবার পর এদেশের গুটিকয়েক ক্রীড়াপ্রেমী উদ্যোগ নিলেন নতুন ক্লাব প্রতিষ্ঠার। তাদের হাতেই গড়ে উঠল ওয়ারী ক্লাব।
তখনকার জমানার একজন খ্যাতিমান ক্রীড়াপ্রেমী ছিলেন রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনাথ রায়। তিনি ছিলেন এ ক্লাব প্রতিষ্ঠার পেছনের মূল কারিগর। তাই তাঁকেই ক্লাব-প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
শুরুতে নানা চ্যালেঞ্জ ছিল। খেলার মাঠ বা ক্লাবহাউস ছিল না তাদের। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ক্লাবটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ১৯৩০ সালে ক্লাবের খেলার মাঠ গড়ে উঠল পল্টন ময়দানে।
খেলায় সাফল্যের দেখাও পেতে শুরু করল দলটি। ক্লাবে তৈরি হলেন বেশ কজন ক্ষণজন্মা ক্রীড়া-প্রতিভা। ১৯১০ সালেই প্রথম বড় সাফল্যটি এসেছিল কুচবিহারে। ব্রিটিশরাজের হাউস ক্লাবকে ওয়ারী ক্লাব হারিয়ে দেবার পর।
আইএফএ শিল্ড টুর্নামেন্টে ওয়ারী ক্লাবের সাফল্য ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বেশ ভালোই ছিল। তবে এ টুর্নামেন্টে ক্লাবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্যটি ১৯১৭ সালের। সেবার তারা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন লিঙ্কন ক্লাবকে হারিয়ে দেয়।
১৯৩১ সালে ক্লাবের কাঠামোতে বিশাল পরিবর্তন এল। ফুটবলের বাইরেও তারা ক্রিকেট, হকি, টেনিস, ভলিবল, টেবিল টেনিসসহ বেশ কিছু ইনডোর গেইম চালু করে। ফলে ক্লাবটি ফুটবল ও হকির টুর্নামেন্টের আয়োজক হবার গৌরবও অর্জন করে। ফুটবলের জন্য নির্মল স্মৃতি ফুটবল শিল্ড ও হকির দুরানো শিল্ডের আয়োজক ছিল ওয়ারী ক্লাবই।
ফুটবলে আধিপত্য তো ছিল বরাবরের মতোই। ১৯৪৮ সালে ওযারী ভিক্টোরিয়া ক্লাবের সঙ্গে যৌথভাবে নার নারায়ণ শিল্ড টুর্নামেন্ট জিতে নেয়।
ওয়ারী ক্লাবের হকি দলও কিন্তু শুরু থেকেই সাফল্য পেতে শুরু করে। ১৯৫৩ সালে ক্লাবটি হকি লীগে রানার্স-আপ হয়। আর ১৯৬৪ সালে হয় চ্যাম্পিয়ন।
সত্তরের দশকে টেবিল টেনিস দলও সাফল্যের পথে হাঁটতে শুরু করে। ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে ক্লাবের টেবিল টেনিস টিম আখতার মেমোরিয়াল টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট জেতে।
ওদিকে, সত্তর ও আশির দশকে বেশ কয়েকবার লিগ জিতে নিয়ে ভলিবল টিমটিও দেশের অন্যতম শক্তিশালী ভলিবল দল হয়ে ওঠে।
একসময় ফুটবলে প্রাধান্য খুইয়ে ফেলে ওয়ারী ক্লাব। কিন্তু এরপরও যে কোনো টুর্নামেন্টে আপসেট ঘটিয়ে ফেলার ক্ষমতা ছিল বলে ওদের বিপজ্জনক দল বলে মনে করা হত।
খেলাধুলার জগতে সদম্ভে পদচারণার সেসব অতীত ইতিহাস খুইয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ারী ক্লাব হয়ে উঠেছে অবৈধ জুয়ার ব্যবসার আখড়া। জাগোনিউজের বিশেষ প্রতিনিধি আরিফুর রহমান বাবু এ নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন:
“আমার মনে আছে ১৯৭৮ সালের কথা। ওয়ারী ক্লাবকে মনে করা হত জায়ান্ট-স্লেয়ার। বড় বড় ব্যানারে স্লোগান লেখা থাকত, ‘ওয়ারী আইলো’। দুঃখজনক যে, এমন একটা ক্লাব জুয়ার আখড়া হয়ে উঠল।”
ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বাবু ওয়ারী ক্লাবের এমন পরিণতির সূত্র খোঁজার চেষ্টা করলেন:
“ক্লাবগুলো নিজেদের ব্র্যান্ডিং বা মার্কেটিংয়ের কাজটা কখনও ভালোভাবে করেনি। একদিকে খরচ বেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে তহবিলের জোগান কমতে থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু লোক এখানে ঢুকে পড়েছে। ওরা ক্লাবের তহবিল সংকটের বিষয়টার সুযোগ নিতে চেয়েছে। আর এভাবেই ক্লাব হাউসের ভেতরে ওরা গড়ে তুলেছে ওদের অবৈধ জুয়ার কারবার।”
এই দুর্ভাগ্যের চক্কর থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসে ক্লাবটি, সেটাই দেখার বিষয়।