ভারতের ক্ষুদ্ধ কৃষকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে
ভারতীয় রাজনীতিতে সব সময়ই তৃতীয় এক ফ্রন্ট হিসাবে আছে কৃষি। ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশটির বাজার আংশিকভাবে বৈশ্বিক মুক্তবাজার অর্থনীতির জন্য উন্মুক্ত করা হলেও, সেই প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছেন কৃষির উপর নির্ভরশীলরা। অথচ জীবিকার জন্য এখাতের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করেন দেশটির পাঁচভাগের তিনভাগ জনতা।
এ অবস্থায় গত সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার কৃষি ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদিত ফসল বিক্রয়ের অতি-দরকারি একটি সংস্কার ঘোষণা করে। এরপরই রাজধানী দিল্লিতে পদযাত্রা করেছে লাখ লাখ বিক্ষুদ্ধ কৃষক।
সাম্প্রতিক সংস্কারের বিরুদ্ধেই কৃষকদের সকল ক্ষোভ, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ এর মাধ্যমে মধ্যসত্ত্বভোগীদের ভূমিকা খর্ব করা হয়। আরও বন্ধ করা হয় সরকারি গুদামগুলোতে শস্য সংগ্রহে গড়পড়তা পাইকারি দর নির্ণয়ের একচেটিয়া প্রথা। ফলে চাষিরা এখন সরাসরি তাদের পণ্য সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রয়ের সুযোগ পাবেন।
এই কৃষকেরা হচ্ছেন সুবিধাপ্রাপ্ত এবং তারা সিংহভাগ কৃষক সমাজের বঞ্চণার প্রতিনিধিত্ব করেন না।
আন্দোলনের মুখেও তাই সরকারের পিছু হটার কোনো কারণ নেই, বরং সংস্কারটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করাই দরকার।
এই বঞ্চণার স্বরূপ সবার আগে বুঝতে হবে, যার সঙ্গে জড়িত বর্তমানে প্রচলিত কৃষি সহায়ক নীতি।
অন্যান্য অনেক দেশের মতো ভারত তার কৃষকদের সরাসরি আয় সহায়তা দেয় না। ইতোপূর্বে, নেওয়া নানা কৃষি স্কিম তা করতেও ব্যর্থ হয়। এর পরিবর্তে সরকার চাল ও গমের মতো দানাদার শস্য কিনে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা- ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার গুদামঘরে পরবর্তীতে এসব শস্য মজুত করা হয়। সেখান থেকেই ভর্তুকি মূল্যে তা জন-সাধারণের কাছে বিক্রি করা হয়।
এই ব্যবস্থায় কৃষকদের একটি নির্দিষ্ট মূল্যে তাদের উৎপাদন বিক্রি করতে হতো। পাশাপাশি সহায়তা দেওয়া হতো; চাষাবাদের প্রয়োজনীয় পানি সেচ, সার আর বীজে। এই ব্যবস্থার প্রেক্ষাপট ১৯৬০ এর দশক। ওই সময়ে ভারতজুড়ে দেখা দিয়েছিল অনেক দুর্ভিক্ষ। দেশটি নিজ প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনও করতে পারতো না। অপমানজনক হলেও বেশ ক'বছর মার্কিন খাদ্য সহায়তার উপর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে ভারত। তৎকালে একে বলা হতো; 'শিপ টু মাউথ এক্সিসটেন্স।'
ওই সময়েই মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনের চাপে ও আমেরিকান অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ অনুসারে ভারতীয় নীতি-নির্ধারকেরা সোভিয়েত অর্থনৈতিক মডেল পরিত্যাগ করে। তার বদলে নেওয়া হয় ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের নীতি। এরসঙ্গে পরবর্তীতে আবিষ্কৃত উচ্চ-ফলনশীল শস্যবীজের প্রভাব যুক্ত হয়ে তথাকথিত 'সবুজ বিপ্লব' ঘটে যায়, যার মাধ্যমে মাত্র এক দশকের কম সময়ে গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে।
তবে এই ভর্তুকির নীতিতে চাষিরা শুধু চাল আর গম উৎপাদনেই বেশি উৎসাহ পায়। কমে যায় শাক-সবজির আবাদ। এই সবজি জাতীয় ফসলেই দরের তারতম্য বেশি দেখা যায়। এমনকি খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও সবজির বাড়তি দরের কারণে প্রায়শই বাধাগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, ভারত এখন বিপুল পরিমাণে দানাদার শস্য উৎপাদন করে। সরকারি গুদামঘরেও পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয় এর বড় এক অংশ। দুর্ভিক্ষের কালে প্রণীত কৃষি নীতি যে আজকের ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়- এ অবস্থা তারই ইঙ্গিত। অধুনা ভারতের লক্ষ্য শুধু ক্ষুধা নির্মূল নয়, বরং সুষম পুষ্টি চাহিদা পূরণ হওয়া উচিৎ।
তাছাড়া, পূর্বের কৃষি নীতি ভৌগলিকভাবেও বৈষম্যের সৃষ্টি করে। এত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে উত্তর ভারতে সমৃদ্ধশালী প্রদেশ পাঞ্জাব এবং তার আশেপাশের কিছু অঞ্চল। এই অঞ্চলে ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশের বসবাস হওয়া সত্ত্বেও চলতি বছরের শুরুতে ভারত সরকার যে পরিমাণ শস্য সংগ্রহ করে- তার পাঁচভাগের চারভাগ কেনা হয় পাঞ্জাব থেকে।
রাজ্যটি আধা-মরুসম হলেও এখানে সেচের পানি বেশি লাগে এমন শস্য তথা- ধানও উৎপাদন করা হয়। চাষিরা বিনামূল্যের বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমেই পাম্প চালিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে তা জমিতে দেয়। ফলে আশঙ্কাজনক মাত্রায় নেমেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এছাড়া, বিদ্যুতের এই ভর্তুকি রাজ্যটির মোট বাজেট বরাদ্দের ১০ শতাংশ দখল করেছে, ফলে দেখা দেয় অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে দরকারি তহবিলের সঙ্কট।
দিল্লিতে যারা বিক্ষোভ করতে এসেছেন, তারা বেশিরভাগই ওই অঞ্চলের সুবিধাভোগী কৃষক। তারা পড়েছেন আস্থার সঙ্কটে। সরকার অবশ্য তাদের আশ্বস্ত করে বলেছে, বর্তমান ফসল সংগ্রহ নীতি পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু, সেপ্টেম্বরে কোনো প্রকার সংলাপের সুযোগ না রেখেই দ্রুত এ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায়, চাষিরা সরকারি প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারছেন না।
আস্থা অবশ্য রাখা উচিৎ নয়। কারণ, বৈষম্যহীন কৃষির স্বার্থেই বর্তমান ব্যবস্থার বিলুপ্তি দরকার। এটি টেকসই কোনো পদ্ধতিও নয়। ঐতিহাসিকভাবে, এই ভর্তুকিগুলো রাজনৈতিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, শুধুমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত কৃষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকেও প্রায় জিম্মি করে রাখে ।
কিন্তু, গণতন্ত্রে সিংহভাগের সমর্থনহীন এই ব্যবস্থা সরকার বেশিদিন টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক প্রেরণা পাবে না। নতুন সংস্কারের আওতায় প্রণীত কৃষি আইন যে পুরোনো ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে, বিক্ষোভকারীরা তা ঠিকই বুঝতে পারছে। একারণেই, ভারতের অন্যান্য স্থানে মূল্য সহায়ক নীতির সমর্থনে সামান্যই বিক্ষোভ হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাও হয়নি। তাই যারা সরকার সমর্থিত মূল্য ও ভর্তুকির কৃষিতে নির্ভরশীল ছিলেন তারা যেন অমোঘ নিয়তিরই সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
- লেখক: ব্লুমবার্গে মতামত কলাম লেখক। পাশাপাশি তিনি ভারতীয় দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কলামিস্ট। তিনি 'রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি' বইটির লেখক।