টিকার প্রায় সব চালান কিনে ফেলেছে ধনী দেশগুলো
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের শেষ ধাপ পাড়ি দিয়ে বাজারে আসছে একের পর এক করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন। যেসব টিকা শেষ ট্রায়ালেও সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলো প্রাপ্তিতে উন্নত দেশগুলো এগিয়ে। এমনকি আগামী বছরের শেষ পর্যন্ত টিকার যতগুলো ডোজ বাজারে পাওয়া যাবে, তার অর্ধেকই অগ্রিম কিনে রেখেছে ধনী দেশের সরকার সমূহ।
এই ঘটনা টিকার মতো প্রাণদায়ী উপাদানেও চরম বৈষম্যে তুলে ধরে।
জাতিসংঘের কোভাক্স জোটের কল্যাণে অনেক দরিদ্র দেশ ২০২১ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য টিকার ডোজ পাবে। কিন্তু, শীর্ষ ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ ডোজ কিনেছে, তা দিয়ে তাদের মোট জনসংখ্যাকে কয়েকবার টিকা দিতে পারবে।
উচ্চ আয়ের দেশে জনসংখ্যার শতাংশ অনুপাতে টিকার ডোজ ক্রয়ের চিত্র:
শুরুতে যখন কোন প্রার্থী টিকা সফলতার মুখ দেখবে তা সুনিশ্চিত ছিল না, তখন থেকেই ধনী দেশেরা একাধিক প্রার্থী টিকা ক্রয়ে উদ্যোগী হয়। অগ্রিম কেনা এসব ডোজের সবগুলো যদি সরবরাহ করা হয় তাহলে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এর সমস্ত বাসিন্দাকে দুইবার টিকা দিতে পারবে। আর ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারবে চারবারের বেশি! কানাডার ক্ষেত্রে তা ছয়গুণ।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিসেফ এবং বৈজ্ঞানিক উপাত্ত বিশ্লেষক সংস্থা এয়ারফিনিটি টিকার এসব অগ্রিম চালানের ক্রয়চুক্তি সংগ্রহ করে। সেখানে উল্লেখিত তথ্য বিশ্লেষণ করেই এবিষয়ে নিশ্চিত করেছে প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
'উচ্চ আয়ের দেশগুলো টিকা পাওয়ার সুযোগের দিক থেকে সামনের সারিতে আছে। আর সেই সুযোগ নিয়ে তারা অর্ধেক চালান কিনে নিয়েছে,' বলছিলেন ডিউকের গবেষক আন্ড্রেয়া টেইলর। তিনি চুক্তিপত্রগুলো খতিয়ে দেখে এমন কথা বলেছেন।
সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পাঁচ কোভিড-১৯ প্রার্থী টিকা গবেষণা, উন্নয়ন আর উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি অর্থ লগ্নি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই বিনিয়োগে প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টায় ব্যাপক অগ্রগতি আসে। বড় আকারে সরকারি প্রণোদনার এ উদ্যোগ ছাড়া হয়তো এত দ্রুত গবেষণা করাও সম্ভব হতো না। কিন্তু, মার্কিন সরকার শুরুতেই শর্ত বেঁধে দেয় যে: যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত টিকার ডোজ প্রাপ্তিতে অবশ্যই মার্কিন নাগরিকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য ধনী দেশগুলোও অগ্রিম ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়। তাদের করা চুক্তিতে পরবর্তীকালে প্রয়োজন দেখা দিলে আরো বেশি পরিমাণ ডোজ সরবরাহের শর্তও রাখা হয়েছে। ফলে অন্য দেশগুলোর জন্য সঠিক সময়ে ফলপ্রসূ টিকা কেনার সুযোগ হয়ে পড়েছে সীমিত।
যুক্তরাষ্ট্র ফাইজার উৎপাদিত টিকার ১০ কোটি ডোজ কেনার চুক্তি করেছে। প্রয়োজনে কেনার শর্ত রাখা হয়েছে আরো ৫০ কোটি ডোজ। মডের্না'র টিকা ২০ কোটি ডোজ প্রাথমিকভাবে কেনার চুক্তি হলেও, অতিরিক্ত ক্রয়ের সুযোগ আছে আরো ৩০ কোটি ডোজ।
এছাড়া, দেশটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন, নোভাভ্যাক্স এবং সানোফির মোট ৮১ কোটি ডোজ উৎপাদন পূর্ব ক্রয় করেছে। ক্রয়াদেশ বাড়ানো হলে যা ১৫০ কোটিতে পৌঁছাবে।
ব্রিটেন আলোচিত সব কোম্পানির ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডোজ অর্ডার করেছে। এরমধ্যে অবশ্য ভ্যালনেভা নামের আরেকটি ছোট কোম্পানিও আছে। বর্তমান চুক্তির সীমা বাড়ানো হলে অতিরিক্ত ১৫ কোটি ২০ লাখ ডোজ কিনতে পারবে দেশটি।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন এসব কোম্পানির মোট ১৩০ কোটি ডোজ প্রাথমিকভাবে কিনেছে। জার্মান কোম্পানি কিউরভ্যাক-ও আছে এই তালিকায়। ক্রয়চুক্তি অনুসারে জোটটি চাইলেই আরো ৬৬ কোটি ডোজ অর্ডারের সুযোগ পাবে।
করোনা প্রতিরোধের বেশিরভাগ টিকা দুই ডোজ করে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। ধনী দেশগুলো সকল জনগোষ্ঠীকে কত দ্রুত এভাবে তা দিতে পারবে সেটাও নিশ্চিত নয়। এক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা হিসেবে কাজ করছে একেক প্রার্থী টিকার গবেষণায় একেক রকম অগ্রগতি। তাই অচিরেই তারা টিকার চালান দরিদ্র দেশে বিপণনে ছাড় দেবে এমনটা ভাবার সুযোগ নেই।
স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদন দরিদ্র দেশগুলোর জন্য অতি-প্রয়োজনীয় হতে পারে:
তবে তুলনামূলক কম ধনী সব দেশ টিকা সঙ্কটে পড়বে তাও নয়। ওষুধ উৎপাদনে নিজস্ব সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু দেশ আবার আগামী বছর নাগাদ বাজারে আসা প্রতিষেধকের বড় চালান প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে।
এদিক থেকে এগিয়ে আছে প্রতিবেশী ভারত। গতবছর নাগাদ দেশটিতে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি টিকার ডোজ উৎপাদিত হবে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং নোভাভ্যাক্সের প্রতিষেধক বিপুল সংখ্যায় উৎপাদনের লাইসেন্স পেয়েছে দেশটির কিছু কোম্পানি। বিনিময়ে ভারত সরকার উৎপাদিত ডোজের অর্ধেক অন্যান্য উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইসেন্স ওষুধ উৎপাদক পুনে ভিত্তিক সেরাম ইনস্টিটিউড। সংস্থাটির মুখ্য নির্বাহী আদর পুনেওয়াল্লা বলেন, 'এটি আমার নিজের দেশ, তাই সবার আগে ভারতের চাহিদাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।'
অন্যদিকে, মেক্সিকোর বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী কার্লোস স্লিম লাতিন আমেরিকার দেশসমূহে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১৫ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করেছেন। এর সাহায্যে আর্জেন্টিনা এবং তার নিজ দেশ মেক্সিকোতে উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
সংরক্ষণের সুবিধা এবং কম দামের কারণে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বেশি উপযুক্ত। এজন্য অন্যান্য প্রার্থী টিকার তুলনায় এটিই সবচেয়ে বেশি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩২১ কোটি ডোজ। অর্ধেক পাবে দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশসমূহ। এজন্য কোম্পানিটি বিশ্বজুড়ে ১০টি শীর্ষ উৎপাদক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে।
জনসন অ্যান্ড জনসন এক ডোজ করে দেওয়ার জন্য একটি টিকার পরীক্ষা চালাচ্ছে। পরিমাণে কম লাগায় এটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য আরেকটি সম্ভাবনা। কোম্পানিটি এই টিকার ৫ লাখ ডোজ স্বল্প আয়ের দেশে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এই অল্প পরিমাণ টিকা কোন কোন দেশ পাবে সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ টিকা উৎপাদক চীন উন্নয়নশীল দেশের জন্য টিকা সরবরাহের আগ্রহ দেখিয়েছে। গত সপ্তাহে প্রথম চীনা কোম্পানি সাইনোফার্মের তৈরি একটি টিকার অনুমোদন দেয় সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসময় শেষ ট্রায়ালের প্রাথমিক ফল অনুসারে টিকাটি ৮৬ শতাংশ সফল বলে জানানো হয়।
টিকা বৈষম্য নিরসনে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) নিরলসভাবে কাজ করছে। তাদের সহযোগী হয়েছে দুটি অলাভজনক সংস্থা। যার মধ্যে আছে মার্কিন ধনকুবের বিল গেটসের একটি উদ্যোগ। সম্মিলিত এ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই ৯২টি দরিদ্র দেশের জন্য শতকোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরও শত কোটি ডোজ সরবরাহ করা হবে মধ্য ও উচ্চ আয়ের দেশে।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস