মহাবিপন্ন অবস্থা থেকে আবারও বনে ফিরবে কচ্ছপ!
১৯০৮ সালে সারা বিশ্বে আরাকান কাছিমকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে কচ্ছপ গবেষকেরা। কিন্তু বিলুপ্তি ঘোষণার প্রায় শতবছর পর ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আলিকদমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আরাকান কাছিমের দেখা পায় ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্সের গবেষকদল। বর্তমানে এই কাছিমের প্রজনন করে এদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে তারা। সেই সাথে বিলুপ্ত হওয়ার শেষ প্রান্তে থাকা আরও ৫টি প্রজাতি নিয়ে তারা কাজ করছেন।
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স সুত্রে জানা যায়, পৃথিবীতে টিকে থাকা আদিম প্রাণিগুলোর মধ্যে কচ্ছপ-কাছিম অন্যতম। শতশত বছর ধরে প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে তারা আজও বেঁচে আছে। আমাদের দেশের বন-জঙ্গলে এক সময় প্রচুর কচ্ছপ ও হাওড় অঞ্চলে কাছিমের দেখা মিলত। তবে নানা কারণে কমছে কচ্ছপ-কাছিমের সংখ্যা। ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স'র তথ্যমতে, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ৩৬১ প্রজাতির কচ্ছপ-কাছিম টিকে রয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বর্তমানে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশে ২৫ প্রজাতির মিঠাপানির কচ্ছপ-কাছিমের দেখা মেলে। এর মধ্যে ২১ প্রজাতির কচ্ছপ-কাছিমকে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীব্যাপী বিপন্ন, মহাবিপন্ন ও সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে আইইউসিএন-ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন নেচার।
কচ্ছপ এবং কাছিমকে আলাদা করার সহজ উপায় হলো, যেগুলো পানিতে থাকে সেগুলো কাছিম এবং যেগুলো স্থলে বসবাস করে সেগুলো কচ্ছপ। যদিও আরো কিছু ব্যাখা রয়েছে।
বাসস্থানের অভাব, প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংস, কৃষি জমি তৈরি বা চাষের জন্য বনভূমি পোড়ানো এবং বিশেষ কিছু ধর্মের মানুষের কাছে কচ্ছপের মাংস প্রিয় হওয়ায় শিকারের উৎসবে হারিয়ে যাওয়ার শেষ প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশের কচ্ছপ এবং কাছিম। বিলুপ্ত হওয়ার শেষ প্রান্তে থাকা এসব কচ্ছপ এবং কাছিমকে সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স।
এরই মধ্যে মহাবিপন্ন চার প্রজাতির কচ্ছপ এবং কাছিম উদ্ধার করে গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের এদের বংশ বিস্তার করা হচ্ছে। যদিও শুরুটা এত সহজ ছিলনা। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়েছে। তাদের খাবারের জন্য লাগানো হয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং সবুজ ঘাস।
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্সের তথ্য বলছে, পার্বত্য অঞ্চলে জীব বৈচিত্র্যের বাস্তব চিত্র জানতে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জরিপ চালায় সংগঠনটির গবেষকরা। পার্বত্য অঞ্চলের আলীকদম, থানচি উপজেলার সাঙ্গু মাতামুহুরির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুর্গম এলাকায় সবচেয়ে বেশি সার্ভে করা হয়। কচ্ছপ সংরক্ষণের প্রথম ধাপ হিসেবে স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে ১০ টি গ্রামের ১২০ জন পাহাড়ি শিশুদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করে কচ্ছপ সম্পর্কে সচেতন করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেন। দ্বিতীয় ধাপে ২০১৭ সালে গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে বাংলাদেশ বনবিভাগের সহযোগীতায় কচ্ছপ সংরক্ষণ সেন্টারে মহাবিপন্ন ১৬টি আরাকন কাছিম, শীলা কচ্ছপ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ ও দিবা কচ্ছপ দিয়ে এদের বংশ বিস্তারের কার্যক্রম শুরু করেন।
২০১৯ সালে এখানে আরও ১১টি এবং ২০২০ সালে আরও ১২ টি কচ্ছপ যুক্ত হয়ে বর্তমানে ওই সেন্টারে ৩৯ টি কচ্ছপ এবং কাছিম রয়েছে। ২০১৯ সালে থেকে এখন পর্যন্ত এখানে ১০২ টি শিলা কচ্ছপের বাচ্চা প্রজনন হয়।
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশনের কর্মকর্তা সরীসৃপ গবেষক শাহারিয়ার সিজার বলেন, "আমরা প্রতি বছর অন্তত ২০০ কচ্ছপ বনে ফিরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু এটি সময় সাপেক্ষ। কারণ আমাদের কাছে যে কচ্ছপ রয়েছে তার অনেকগুলোই প্রাপ্তবয়ষ্ক নয়। একটি কচ্ছপ বা কাছিমের প্রজনন ক্ষমতা আসতে আট থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লাগে। ইতিমধ্যে মহা বিপন্ন শীলা কচ্ছপের ৪৬টি বাচ্চা আমরা প্রথম বারের মত উৎপন্ন করেছি। আমাদের প্রত্যাশা ২০২১ সালে পরীক্ষামূলক ভাবে কিছু কচ্ছপের বাচ্চা আমরা বনে ফিরিয়ে দেব। তবে কোন বয়সের বাচ্চা ছাড়া হবে, কোথায় ছাড়া হবে বা কি প্রক্রিয়ায় ছাড়া হবে তা নিয়ে আমরা গবেষণা করছি কারণ তাদের বেঁচে থাকা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তবে সব মিলিয়ে আমরা সঠিক পথেই আছি।"
তিনি আরও জানান, আমরা যেসব প্রজাতির বংশ বিস্তারে কাজ করছি তার মধ্যে মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি প্রজাতি মহাবিপন্ন আরাকান কাছিম। এই কাছিমকে ১৯০৮ সালে সারা বিশ্বে বিলুপ্ত ঘোষণা করে কচ্ছপ গবেষকেরা। কিন্তু বিলুপ্তি ঘোষণার প্রায় শতবছর পর ২০০৯ সালে মায়ানমারে আরাকান কাছিমের দেখা পায় ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি মায়ানমার এবং টার্টেল সার্ভাইবাল এলায়েন্স। ২০০৯ সালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আলিকদমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আরাকান কাছিমের দেখা পায় ক্রিয়েটিভ কনজারভেশনের গবেষকদল। এর আগে ধারণা ছিল এই প্রজাতি আরাকান রাজ্যের বাইরে আর কোথাও নেই।
ভাউয়াল কচ্ছপ সেন্টারের বাইরেও কাছিমের প্রজননের কাজ করছেন এবং ইতিমধ্যে বড় সফলতা পেয়েছেন জানিয়ে শাহারিয়ার সিজার বলেন, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামির মাজারে যে কাছিম রয়েছে তা বায়োজিদ বোস্তামির কাছিম হিসেবে পরিচিত। এদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ছিল যে, মাজারের এই বিশেষ কাছিম বাইরে কোথাও নেই। কিন্তু ২০১২ সালে অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞানি পিটার প্রাসচাগের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয় ভার্টিব্রেট জিউলজি জার্নালে। তিনি উপমহাদেশের কচ্ছপ এবং কাছিমের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
উপমহাদেশের কচ্ছপ কাছিমের ডাটা এবং জিনগত গবেষণা করে জানান, বায়োজিদ বোস্তামির কাছিম খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি এবং মৌলভীবাজারে পাওয়া গেছে। এছাড়া সিলেট এবং আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের বসবাস রয়েছে।
বোস্তামির কাছিম নিয়ে কচ্ছপ সেন্টারের প্রকল্প ম্যানেজার ফাহিম জামান জানান, "এই কাছিমের বড় একটি অংশ চট্টগ্রামের বায়োজিদ বোস্তামির মাজারে টিকে আছে। ২০০৪ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, তখন পর্যন্ত এর সংখ্যা ছিল ৪০৮টি। এরা প্রজনন মৌসুমে পানি থেকে উপরে উঠে মাটিতে গর্ত করে ডিম পারে এবং মাটি দিয়ে সে গর্ত ঢেকে দেয়। এটাই তাদের স্বাভাবিক প্রজননের নিয়ম। কিন্তু পুকুরের দূষিত পানি ও পুকুর পাড়ের মাটি শক্ত হওয়ায় ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। এ ছাড়া ডিম দেওয়ার জন্য নিরাপদ জায়গা না থাকা এবং কুকুর, বিড়াল ও কাকসহ বিভিন্ন প্রাণী এদের ডিম খেয়ে ফেলাসহ নানা সমস্যায় এদের প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।"
২০১৯ সালে প্রথম বারের মত মাজারের পুকুরের পাশে একটি ঘরে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স পরীক্ষামূলকভাবে ৫০টি ডিম থেকে ৩৮টি কাছিমের বাচ্চার জন্ম দিতে সক্ষম হয়। প্রথম বারেই ৮০ শতাংশ সফলতা আসে। ২০২০ সালে ২০৫ টি বাচ্চা পাওয়া যায়।
২০০৬ সালে মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে পুকুরে বিষ প্রয়োগ করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনার উদাহরন টেনে শাহারিয়ার সিজার বলেন, বিশ্বব্যাপী মহা বিপন্ন বায়োজিদ কাছিম এখন একটি পুকুরে রয়েছে। ২০০৬ সালের মতো কোন দুর্বৃত্ত যদি একই কাজ করে তবে এই প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি হবে। তাই আমরা আলাদা একটি পুকুরে কিছু কাছিম সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা মাজার কমিটিকে জানিয়েছি এবং তারাও আগ্রহী।
কাছিম পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় জানিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের লক্ষ্য হলো কচ্ছপ-কাছিমের প্রজননের মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন করে সেগুলো বনে ছেড়ে দেওয়া। কচ্ছপ প্রাপ্ত বয়ষ্ক হতে যেহেতু সময় লাগে তাই আমাদের লক্ষ্য অর্জনে একটু সময়ের প্রয়োজন। আশা করছি আগামী ২/৩ বছরে সে লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে, কারণ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া সংরক্ষণ সম্ভব নয়।"