তিন বছরের প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে ১২ বছর, ব্যয় বাড়ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা
ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়ক ধরে গোপালগঞ্জ পৌর এলাকার শেষ প্রান্তের ঘোনাপাড়া মোড় পার হলেই চোখে পড়বে দৃষ্টিনন্দন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল আর তার পাশের বিশাল বালির ঢিবি।
এ বালির মধ্যেই উঁকি মারছে সরকারের এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) তৃতীয় প্ল্যান্ট নির্মাণ প্রকল্পের জরাজীর্ণ সাইনবোর্ডটি যার ঠিক পেছনে ২০১১ সাল থেকে চলছে কারখানা স্থাপনের কাজ।
তিন বছরের কম সময়ে নতুন কারখানার চারটি ইউনিটের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চার দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাত বছর। তারপরেও শেষ হয়নি কারখানা নির্মাণের কাজ। এখন আবার দুই বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব অনুমোদন করলে এবং শেষ পর্যন্ত বর্ধিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ইডিসিএল তিন বছরের কাজ শেষ করবে এক যুগে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক এই কালক্ষেপনে বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়ও। ৩১৫ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় আড়াই গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকা।
ইডিসিএলের এমডি ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক ডা. এহসানুল কবির সংশোধিত প্রকল্প নিয়ে অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় জানান, "তিনটি প্রোডাকশন ইউনিটের ইন্সটলেশন, টেস্টিং, কমিশনিং, ভেলিডেশন, ব্যালান্সিং ও কোয়ালিফিকিশনের কাজ এখনো বাকি আছে"।
তিনি আরও জানান, কোভিডের কারণে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের অনেকেই দেশে নাই। এ কারণেই এসব কাজ বন্ধ আছে। এ অবস্থায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরো দু'বছর সময় লাগবে।
ইডিসিএল'র প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এসেছেন আইএমইডির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুর রহমান। তিনি জানান, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই সরেজমিন এই পরিদর্শন। প্রকল্পের দলিলপত্র পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি না করা পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।
আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, "একটি ওষুধ কারখানা স্থাপনে ১২ বছর সময় লাগার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এজন্য প্রকল্পের অগ্রগতির খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা হবে"।
ইডিসিএল সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। দেশের সব সরকারি হাসপাতালের ওষুধের চাহিদার ৮০ ভাগ এবং প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের চাহিদার শতভাগ যোগান আসে এই প্রতিষ্ঠান থেকে।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ইডিসিএলের মূল কারখানা। খুলনায় প্রতিষ্ঠানটির কনডম তৈরির একটি প্ল্যান্ট আছে। গোপালগঞ্জের প্ল্যান্টটি ইডিসিএলের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ প্ল্যান্ট।
কেন এই প্রকল্প?
ইডিসিএলের তেজগাঁওয়ের মূল কারখানায় গত শতকের ষাটের দশকে স্থাপন করা যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সরকারি পর্যায়ে ওষুধের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না।
এ কারণে চাহিদার অন্তত ৩০ শতাংশ ওষুধ বেসরকারি কারখানা থেকে উৎপাদন করে দিতে হচ্ছে ইডিসিএলকে। এ জন্য প্রতিবছর প্রায় ১৯০ কোটি টাকা ব্যয় এসব কোম্পানিকে পরিশোধ করতে হয়।
পুরাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে 'কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস'(সিজিএমপি) ধরে রাখা যাচ্ছিল না। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিশু সংস্থা (ইউনিসেফ), যুক্তরাজ্যভিত্তিক মেডিসিন এন্ড হেলথকেয়ার প্রডাক্ট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমএইচআরএ), ইউরোপীয়ান মেডিসিন ইভালুয়েশন এজেন্সি ( ইএমইএ)সহ বেশ কিছু বিদেশি সংস্থা ইডিসিএলকে দেয়া এন্ডোর্সমেন্ট সার্টিফেকশন প্রত্যাহার করে নেয়। এর প্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফএবং আইসিডিডিআরবি ইডিসিএল থেকে ওষুধ কেনা বন্ধ করে দেয়।
একই প্ল্যান্টে পেনিসিলিনের পাশাপাশি অন্যান্য ওষুধ উৎপাদন সিজিএমপি বিরোধী বিবেচনায় ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ইডিসিএল পরিদর্শন করে ঢাকার কারখানাটি স্থানান্তরের পরামর্শ দেয়।
এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে গোপালগঞ্জে ইডিসিএলের নতুন একটি প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১১ সালের শুরুর দিকে ৩১৫ কোটি টাকার এই প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়। প্রকল্প প্রস্তাবে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
খুলনায় ইডিসিএলের কনডম তৈরির একটি কারখানা থাকলেও দেশে বহুল ব্যবহৃত মুখে খাওয়ার ও ইনজেক্টেবল জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর কোন কারখানা নেই। প্রতি বছর ১৫ কোটি সাইকেল চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ খাবার পিলের বড় বাজারগুলোর একটি। দেশে ইনজেক্টেবল জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।
জন্মনিয়ন্ত্রণের এ ধরনের সামগ্রী উৎপাদনের কোন কারখানা দেশে না থাকায় চাহিদার পুরোটাই মেটাতে হয় আমদানি করে। এজন্য গোপালগঞ্জের কারখানায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী তৈরির একটি ইউনিটও স্থাপন করা হবে।
তিন বছর থেকে একযুগ!
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত সময় কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রথম দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় দুই বছর। এরপর দ্বিতীয় দফায় দুই বছর, তৃতীয় দফায় আরো এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের জুনে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু তাতেও নির্ধারিত সময়ে ইডিসিএল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায় চতুর্থ দফায় মেয়াদ আবারো দুই বছর বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
এই মেয়াদ পার হয়ে গেলে আরো দুই বছর সময় চেয়ে (২০২২ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত) সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
কয়েক দফা সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, যা মূল বরাদ্দের চেয়ে আড়াই গুন বেশি।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির সভায় বলা হয়েছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ৫৯০ কোটি টাকা বা ৭৩.৭৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এই প্রকল্পে ১১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ২.৩২ কোটি টাকা।
প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি
গোপালগঞ্জের ঘোনাপাড়া মোড় পেরিয়ে হাতের ডান পাশে চলছে ইডিসিএলের নতুন কারখানা স্থাপনের কাজ। প্রকল্পের সীমানা প্রাচীর থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত বালির বিশাল স্তুপ। মহাসড়ক থেকে কারখানা পর্যন্ত প্রবেশপথটি এখনো কাঁচা। তৈরি করা হয়নি ভেতরের রাস্তাগুলোও।
শেষ পর্যায়ে থাকা আয়রন ট্যাবলেট উৎপাদন ভবনের ক্লিনরুম নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ চলছে। ফার্নিচার ও অন্যান্য আসবাব স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি।
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী উৎপাদন ইউনিটের ক্লিনরুম ও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ এখনো চলমান। এই ইউনিটের কিছু যন্ত্রপাতির সরবরাহ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জনিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
আইভি ফ্লুইড উৎপাদন ভবনের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি; বাকি আছে ক্লিনরুম ও বিদ্যুৎ সংযোগের কাজও। এই ইউনিটের মাত্র ৩০ শতাংশ যন্ত্রপাতি এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ ভবনে যন্ত্রপাতি ও রেক স্থাপনের কাজ চলছে। ইটিপি, এসটিপি, ইনসিনারেট, সলভেন্ট স্টোর স্থাপনের কাজ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত শেষ হয়েছে।
গোপালগঞ্জে চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এটি হবে ইডিসিএলের সর্ববৃহৎ প্ল্যান্ট। এখানে চারটি ইউনিটের প্রথমটি নিয়োজিত থাকবে পেনিসিলিন উৎপাদনের জন্য। একটি প্ল্যান্টে বিভিন্ন ধরনের জীবন রক্ষাকারী আইভি ফ্লুইড, একটিতে আয়রন ট্যাবলেট ও অন্যটিতে জন্মনিরোধক খাবার বড়ি ও ইনজেকশন উৎপাদন হবে।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে ইডিসিএলের এই কারখানাটিও উদ্বোধন করেছিলেন। গত বছরের জুলাই মাস থেকে কারখানার পেনিসিলিন ইউনিটে উৎপাদন কাজ চলছে।
প্রকল্পে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপনের কাজ করছে স্পেন, ভারত, ইটালি, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও চীনের প্রতিষ্ঠান ও প্রকৌশলীরা।
বিলম্বের আর্থিক মাশুল বিশাল
সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় ৩১৫ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকায়। কারখানা স্থাপনের কাজ সময়মতো শেষ হলে প্রথম বছর ৪০ কোটি টাকার আইভি ফ্লুইড ও ৫০ কোটি টাকার পেনিসিলিন ও ১৫০ কোটি টাকার জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী উৎপাদনের কথা ছিল।
ন্যূনতম উৎপাদন হিসাব করা হলেও ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে ৩৬০ কোটি টাকার আইভি ফ্লুইড, ১৩৫০ কোটি টাকার জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী উৎপাদন হতো। পেনিসিলিন প্ল্যান্টটিতে উৎপাদন শুরু হয়েছে প্রকল্প সমাপ্তির নির্ধারিত সময়ের সাত বছর পর। বিলম্ব না হলে ৩৫০ কোটি টাকা টাকার পেনিসিলিন উৎপাদন হতো।
নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে উৎপাদনজনিত পরোক্ষ ক্ষতির পরিমান ২০৬০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের কাজ শেষ নির্ধারিত সময়ে শেষ হলে ১২০০ থেকে ১৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল। একটি মাত্র ইউনিট চালু হওয়ায় মাত্র ৩০০ লোকের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক বি এম ইমাম হাসান দাবি করেন, "প্রকল্পটি ২০১১ সালে অনুমোদন পেলেও মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হতেই পাঁচ বছর লেগে যায়"। এতোদিন কেন লাগল জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আগে যারা বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন তারা এর কারণ বলতে পারবেন"।
পরের পাঁচ বছরেও কেন কাজ শেষ হলো না জানতে চাইলে তিনি জানান, অধিকাংশ স্থাপনা নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজও শেষ পর্যায়ে। কোভিডের কারণে বাকী কাজের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, অন্তত ছয়টি দেশ থেকে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আসছে। কোভিডের কারণে কিছু যন্ত্রপাতি আসতে পারছে না। আবার বিদেশি টেকনিশিয়ানরাও আসতে পারছেন না।