সোনালী’র দুঃখগাথা
অনিয়ম করে ঋণ বিতরণের পর খেলাপি ঋণ আদায় না করে তা লুকিয়ে রাখার মাধ্যমে পরিচালনগত ঝূঁকিতে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। ঋণতথ্য সিআইবিতে আপলোড না করা এবং বার বার পুনঃতফসিল ও পুনগর্ঠন সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানো ও নগদ আদায়ে অনীহা ও ঝূঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকটিকে এ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অব্যাহতি সুবিধা পাওয়ার পরও ব্যাংকটির ইন্টারেস্ট কাভারেজ রেশিও 'ডিফল্ট' পর্যায়ে নেমে যাওয়ার আশঙ্কার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-২ এর মহাব্যবস্থাপক জীবন কৃষ্ণ রায় স্বাক্ষরিত সোনালী ব্যাংকের বিশদ পরিদর্শন প্রতিবেদনটি গত ২০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো হয়েছে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ব এই ব্যাংকটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন ও নিয়ম ভঙ্গ করে গ্রাহকদের অবৈধ সুবিধা দেওয়া, অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গোপণ রাখা, খেলাপি ঋণ আদায়ে উদাসীনতা ও বারবার পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর তথ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, সোনালী ব্যাংককে ৪৮৬৮ কোটি টাকা ডেফারেল সুবিধা দেওয়ার কারণে ২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংকের কর-পরবর্তী নিট মুনাফার পরিমাণ ছিল ২৭১ কোটি টাকা। সংস্থান ঘাটতি সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড় না দিলে ওই বছর ব্যাংকটির লোকসান হতো ৪৫৯৭ কোটি টাকা। আগের বছরও ব্যাংকটিকে প্রায় একই পরিমাণ সংস্থান সংরক্ষণ হতে অব্যাহতি দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক হতে অব্যাহতি সুবিধা নেওয়ার পরও ব্যাংকটির ইন্টারেস্ট কাভারেজ রেশিও (আইসিআর) ০.০৫। অব্যাহতি সুবিধা না দিলে হতো ঋণাত্বক হতো ১.১৫।
'ব্যাংকটি ইন্টারেস্ট অবলিগেশন পূরণে প্রয়োজনীয় ক্যাশ জেনারেট করতে পারছে না। এ অনুপাত স্ট্যান্ডার্ড মান ১.৫ অপেক্ষা যত কম হবে, ব্যাংকের ডিফল্ট হওয়ার আশঙ্কা তত বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, ব্যাংকটি পরিচালনাগত ঝূঁকিতে রয়েছে'- উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আতাউর রহমান বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সোনালী ব্যাংক ঝূঁকিতে নেই। কারণ, ব্যাংকটি সরকার দ্বারা শতভাগ গ্যারান্টেড প্রতিষ্ঠান।
সরকারি ব্যাংক হওয়ায় মূলধন সংকটে কোন সমস্যা হবে না। কারণ, আমরা সরকারের অনেক কাজ করি। যেহেতু এটা সরকারের ব্যাংক, তাই প্রয়োজনে সরকার ক্যাপিটাল ইনজেক্ট করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুবিধা না পেলে ব্যাংকটির রিটার্ণ অন ইনভেস্টমেন্ট, রিটার্ণ অন ইক্যুইটি, রিটার্ণ অন এসেট ও আর্নিং পার শেয়ার নেগেটিভ পজিশনে থাকতো। অব্যাহতি সুবিধা নেওয়ার পরও এসব সূচকের মান কাঙ্খিত পর্যায়ে নেই। প্রতিবার সংস্থান সংরক্ষণ হতে অব্যাহতি নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখাপেক্ষি না হয়ে শ্রেণীকৃত ঋণ আদায় ও ভাল গ্রাহক সংগ্রহ করে নতুন ঋণ দেওয়াসহ ব্যাংকের আয় বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সোনালী ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আগের পরিদর্শন রিপোর্টেও একই ধরণের পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তার ভিত্তিতে সোনালী ব্যাংক একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল। তাতেও পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি হয়নি জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, 'ব্যাংকটির ঝূঁকি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে'।
সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণ স্থিতির ২০ শতাংশেরও বেশি খেলাপি, যার পরিমাণ প্রায় ১১২০০ কোটি টাকা। এসব ঋণের বড় অংশই আদায় অনিশ্চিত ও ঝূঁকিপূর্ণ বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। 'এসব ঋণের কিস্তি ব্যাংকে ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম বিধায় নিকট ভবিষ্যতে ব্যাংকের নগদ অর্থের প্রয়োজনে তরল সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে' বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের মনে হয়েছে।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের সিইও বলেন, 'প্রতিবেদনটি এখনও আমার হাতে আসেনি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে যেসব ঝুঁকির কথা বলা আছে, সেগুলোর সঙ্গে এগ্রি করি। সোনালী ব্যাংক লেকিংস কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তখন যেসব দূর্বলতা ছিল, তার সবগুলোতে এখন উন্নতি করছি। কমপ্ল্যায়েন্সের দিক থেকে সোনালী ব্যাংক আগের চেয়ে অনেক ভাল।'
সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণ ও অগ্রিমের অর্ধেক বা তারও বেশি অংশ শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছে। অল্পকিছু গ্রাহকের কাছে এতো বেশি ঋণ ব্যাংকটিকে ঝূঁকিতে ফেলছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ১১ শতাংশেরও বেশি এই ২০ ঋণগ্রহীতার কাছে। এর মধ্যে হলমার্কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণের অর্থ আদায়ে কোন অগ্রগতি নেই। শীর্ষ ২০ খেলাপির ঋণের পরিমাণ ৩৫৬৮ কোটি টাকা থেকে ২০১৯ সালে আদায় হয়েছে মাত্র ৩১ কোটি টাকা। গত তিন বছর ধরে এদের কাছ থেকে আদায় পরিস্থিতি সস্তোষজনক নয় বলে মত বাংলাদেশ ব্যাংকের।
'চার বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে নগদ আদায়ের পরিমাণ আরও কমেছে। তবে সুদ মওকুফের পরিমাণ বাড়িয়ে মোট আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। মোট কথা, ব্যাংকের প্রকৃত আদায় পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়'।
খেলাপি ঋণের হার কম দেখানোর জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনগর্ঠনের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তদারকি ও জবাবদিহিতার অভাবে ঋণ আদায় হচ্ছে না। ওই ঋণগুলো পুনরায় খেলাপি হওয়ার প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, 'ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত অস্থিতিশীল ও ঝূঁকিপূর্ণ।'
ঝূঁকি জেনেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকটি। সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। আলোচিত হলমার্ক গ্রুপকেও এ লিমিট লঙ্ঘন করে ঋণ দেয় ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংকের অধিক খেলাপি ঋণ সম্পর্কে আতাউর রহমান বলেন, 'এটা আজকের বিষয় নয়, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল। এখন মাত্র দু'টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিটের চেয়ে বেশি।'
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, মেয়াদোত্তীর্ণের ভিত্তিতে যেসব ঋণ হিসাব খেলাপি হওয়ার যোগ্য, সেগুলোকেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে না ব্যাংকটি। এছাড়া, খেলাপি ঋণ হিসাবগুলোর তথ্যও সিআইবিতে যথাযথভাবে আপলোড করছে না সোনালী। ব্যাংকের ইন্টারনাল অডিট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনেও খেলাপি ঋণের গুণগত মান যাচাই করা হয় না।
এখন সিআইবিতে নিয়মিত তথ্য আপলোড করা হচ্ছে বলে দাবি করেন সোনালী ব্যাংকের এমডি।
পরিদর্শন দলকেও তথ্য দিতে অনীহা দেখানোর মতো মারাত্বক অভিযোগ উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, পরিদর্শন দলকে সঠিক তথ্য প্রদান না করা বা তথ্য দিতে অনীহা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ঋণ হিসাব যথাযথ শ্রেণিমানে প্রদর্শন করার মাধ্যমে ব্যাংকের কমপ্লায়েন্স ঝূঁকির সৃষ্টি করা হয়েছে।
নিয়মানুযায়ী, নির্ধারিত সময়ে খেলাপি ঋণ আদায় না হলে তা অবলোপন করে আদায়ের চেষ্টা করার বিধান থাকলেও তা আদায়ে সোনালী ব্যাংকের কার্যকর উদ্যোগ নেই। এজন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নিচ্ছে না ব্যাংকটির পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এতে প্রতিবছর ঋণ অবলোপন হলেও এর বিপরীতে তেমন কোনো আদায় নেই। পরিদর্শন কালে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৭০৯১ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে আদায় হয়েছে মাত্র ৪৪ কোটি টাকা, যা অবলোপন করা ঋণের ০.৬২ শতাংশ।
আতাউর রহমান বলেন, 'কিছু কিছু ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের সমস্যা ছিল। তবে ২০২০ সালে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। মহামারীর মাঝেও অনেক ভালো করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২০ সালে সোনালী ব্যাংক সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে, সর্বোচ্চ ডিপোজিটও আমাদের।'
মামলাধীন ঋণ আদায়েও গাফিলতি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। পরিদর্শনকালে বিভিন্ন আদালতে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের দায়ের করা ১৯০১৮ মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ২৭০৯২ কোটি টাকা। এছাড়া, বিভিন্ন ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৫৬৪টি মামলা করেছে, যাতে জড়িত অর্থ ৫৫২২ কোটি টাকা।
'ঋণ আদায়ের জন্য দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তির জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনার তদারকিতে ব্যর্থতা ও এ কারণে জবাবদিহিতা না থাকায় দ্রুত নিষ্পত্তিযোগ্য মামলারও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। অথচ মামলা পরিচালনায় ব্যাংকের ব্যয় প্রতিবছর বাড়ছে'- যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম ও কর্মকর্তাদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, 'প্রতারণা ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় শুধু ব্যাংকের ভাবমূর্তিই ক্ষুন্ন হয় না বরং ব্যাংক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়। তাই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশক। অন্যথায় অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কোনক্রমেই সম্ভব হবে না।'
৮৭% ঋণতথ্য সিআইবিতে নেই
নিয়মানুযায়ী, পারসোনাল লোন, ওভারড্রাফট লোন ও কৃষিঋণের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি)তে আপলোড করা হয় না। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক কুইক সামারি প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ঋণতথ্য সিআইবিতে আপলোডের কথা বলেছে, সেগুলোও আপলোড করেনি সোনালী ব্যাংক। গত ৩০ জুন স্থিতি ভিত্তিতে সোনালী ব্যাংকের মোট ঋণ সংখ্যা ১৭ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে ১৫ লাখ ঋণতথ্য সিআইবিতে আপলোড করেনি। এসব ঋণহিসাবে স্থিতির পরিমাণ ২৯,৮৭০ কোটি টাকা। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, সহায়ক জামানতের তথ্য সিআইবিতে আপলোড করার বিধান থাকলেও তা করেনি ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, 'তখন হয়তো সবগুলো খাত দেখা হয়নি। কিছু বাদ পড়ে থাকতে পারে। কিন্তু অর্ধেকেরও বেশি তথ্য সিআইবিতে দেওয়া হয়নি, এটার সঙ্গে আমি একমত না।'
৫২৭৬৭ ক্রেডিট এন্ট্রি ও ৭০৩৬৫ ডেবিট এন্ট্রির সমন্বয় নেই
সোনালী ব্যাংকের আন্তঃশাখা লেনদেনের বেশিরভাগ হিসাবই দু'বছরের বেশি সময় ধরে অসমন্বিত রয়েছে। এসব হিসাবের মধ্যে জালিয়াতি রয়েছে কি-না, তা যাচাই করতে বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে বলেছে পরিদর্শনদল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির প্রায় ৯৫ হাজার ডেবিট এন্ট্রিতে স্থিতির পরিমাণ ৩২১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭০ হাজারেরও বেশি ডেবিট এন্ট্রি দু'বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অসমন্বিত রয়েছে। এসব এন্ট্রিতে স্থিতির পরিমাণ ৬৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া, প্রায় ৫৩ হাজার ক্রেডিট এন্ট্রি অসমন্বিত রেখেছে সোনালী ব্যাংক, যাতে স্থিতি ২৫০ কোটি টাকা।
অন্যান্য দায়ের ক্ষেত্রে বেশকিছু হিসাবের স্থিতি দীর্ঘদিন যাবত অসমন্বিত রয়েছে, যেগুলো ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ও পর্ষদ কমিটি কর্তৃক বিবেচনা করার নজির দেখা যায়নি। এতে কর্তৃপক্ষের তদারকি দূর্বলতা স্পষ্ট বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যবস্থাপনা তথ্য পদ্ধতি (এমআইএস)তে ঝূঁকি
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনকালে দলটি ঋণ সংক্রান্ত যেসব তথ্য চেয়েছে, তা সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডিভিশন সরবরাহ করতে পারেনি। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এনে একীভূত করে পরিদর্শন দলকে সরবরাহ করেছে ব্যাংকটি।
অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণতথ্য এমআইএস থেকে সরবরাহ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল দেখতে পায় যে, শুধু ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় ও রমনা করপোরেট শাখার ঋণগ্রহীতাদের তথ্য আছে। কিন্তু খুলনা করপোরেট শাখার ঋণগ্রহীতা ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন এবং চট্টগ্রামের লালদীঘী করপোরেট শাখার গ্রাহক ও রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলসের পরিচালক মাকসুদুর রহমানের ঋণতথ্য উল্লেখ করা হয়নি। সিআইবিতে সহায়ক জামানতের তথ্য দেওয়ার নির্দেশনাও বাস্তবায়ন করছে না ব্যাংকটি।
'এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যাংকটির এমআইএস এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কর্মক্ষম পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এটি কার্যকর করার জন্য বিগত পরিদর্শনগুলোতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, যা পরিপালনে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয়েছে'- যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বছর ঘুরলেই পাল্টে যায় নিরীক্ষিত তথ্য
২০১৮ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক পরিদর্শনকালে ওই বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে তথ্য পেয়েছে, পরের ডিসেম্বরভিত্তিক পরিদর্শনের সময় সে তথ্য মেলেনি, তথ্য পাল্টে গেছে।
এমন বেশকিছু উদাহরণ তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের বার্ষিক বিবরণীতে ওই বছর পুনঃতফসিকৃত ও পুনগর্ঠিত ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছিল ২৬৮৩.৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালের বার্ষিক আর্থিক বিবরণীতে ২০১৮ সালের পুনঃতফসিকৃত ও পুনগর্ঠিত ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ২৪৮১.৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দু'টি নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতে একই তথ্য ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার বিষয়টি বিভ্রান্তিকর এবং তা আর্থিক বিবরণীর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একইভাবে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে ব্যাংকের সিএল বিবরণীতে দেশের ভেতরে ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৫৫০৬৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতে এর পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৫৪৭৬৮ কোটি টাকা, যা বিভ্রান্তিকর বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।