সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব ক্ষুন্ন হওয়ার শঙ্কা থেকেই মিয়ানমারে ‘ক্যু’
পৃথিবীর এক অদ্ভুত ভূখণ্ড মিয়ানমার। এককালের বার্মা নামের এই দেশটি মিয়ানমার হয় সেনাসমর্থিত সরকার দ্বারা। তারা বার্মা নামই পাল্টে দেয় দেশটির।
সাংবিধানিকভাবে এই দেশের ৪৪০ জন পার্লামেন্ট সদস্য, এর মধ্যে ২৫% সামরিক বাহিনী কর্তৃক মনোনীত সামরিক ব্যক্তি। পৃথিবীর কোন দেশে এই ধরনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা নাই। কোনো দেশেই এভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেশের পার্লামেন্টের সদস্য করা হয় না।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি দীর্ঘকাল 'গৃহবন্দি' ছিলেন। পরে সারা বিশ্বের চাপের মুখে সামরিক জান্তা যে সংবিধান রচনা করলেন; সু চি সমঝোতা করে সেই সংবিধান মেনে নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
নয়া সংবিধানের উল্লেখযোগ্য দিকই ছিল; সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরকে পার্লামেন্টে যাওয়ার জায়গা করে দেওয়া। দ্বিতীয় আরেকটি দিক ছিল, সু চি জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক হলেও বিবাহসূত্রে তার স্বামী ব্রিটিশ নাগরিক হওয়াতে; মিয়ানমারের সামরিক জান্তা তাকে প্রেসিডেন্ট পদে অযোগ্য করার লক্ষ্যে যে সংবিধানের ধারা সংযোজন করে, সু চি তা মেনে নিয়েই ২০১৫ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন।
উৎখাতের আগপর্যন্ত দেশটির নেতৃত্বে ছিলেন সু চি। তিনি জেনারেল অং সানের কন্যা। জেনারেল অং সানের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ অবদান ছিল নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য। বার্মা তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার আগে বার্মা একটি বহু-বিভক্ত রাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হতো।
ঔপনিবেশিক শাসনের আগে বার্মায় বহু রাজার ইতিহাস জানা যায়। বার্মায় মোট ৯৪ টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, এদের সবার সংস্কৃতি ধর্মবিশ্বাস সবকিছুই আলাদা। যদিও মূল আধ্যাত্মিক বিশ্বাস- বৌদ্ধ ধর্ম, কিন্তু তা হলেও বহু মতে বিভক্ত এই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।
বার্মায় রোহিঙ্গা জাতিসত্তার ইতিহাসও সহজ নয়, জটিল এবং অস্পষ্ট। তবে এই জাতিসত্তাকে কখনই মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কোনো চেষ্টা হয় নাই। যার জন্য এরা সবসময়ই অন্য জাতিগোষ্ঠী থেকে আলাদা থেকেছে।
সুচির বাবা যখন ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, সেই সময়ে রাখাইনের এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এর কারণ ছিল ব্রিটিশরা তাদেরকে আলাদাভাবে স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রদেশ গঠনের সুযোগ দেবে বলে প্রলোভন দেখায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান কর্তৃক দখলদারিত্বের শিকার হয় বার্মা। সু চির বাবা জেনারেল অং সান তখন জাপানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও তার হাত থেকে বার্মাকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। জেনারেল অং সানকে টোকিওতে সম্বর্ধনা প্রদান করেন জাপানের সম্রাট। জাপান তাকে মিয়ানমারের অর্থাৎ তখনকার বার্মার উত্তরাধিকারী করার ঘোষণাও দেয়। কিন্তু, জাপান ঘোষণা দিয়েও কথা রক্ষা না করায়, জেনারেল অং সান আবার ব্রিটিশদের সঙ্গে মিলে জাপানি দখলের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ঘটলে বার্মার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।
১৯৪৭ সালে জেনারেল অং সান'কে তার নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা বার্মা ছেড়ে গেলে বার্মা স্বাধীন হয়। তবে, দেশের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর কাছেই থেকে রায়। তারপর, ১৯৬২ সালের প্রথম ক্যু' সংগঠিত হয় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে। তিনি এএফপিএফএল' সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন। তারপর থেকে ৫০ বছর ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে। আর এই পুরো সময়ে সেনা শাসনকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়েছে প্রধানত চীন। চীনের এই সমর্থনে এই দীর্ঘ পাঁচ দশক সামরিক জান্তা ও তাদের সহযোগিরা চরম লুটপাট চালায়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে চীনের সাথে অব্যাহতভাবে ভারতও সমর্থন জুগিয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। দেশটির খনিজ তেল এবং অন্যান্য সম্পদের উপর চীনারা নানানভাবে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করেছে ওই পাঁচ দশকের সেনা শাসনের সময়।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়ায়; সব সময়েই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মুসলিম পরিচয়ই প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে। ফলে আমরা মিয়ানমারের প্রতিবেশী বন্ধু হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারিনি। প্রায়শই আমরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমাদের সৃষ্ট একটি জাতিগত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তাই মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ সময়েও আমাদের তেমন কোন যোগাযোগ সৃষ্টি হয়নি।
যদিও, আমরা নানান পণ্য মিয়ানমার থেকে আমদানি করি, কখনো কখনো চাল মাছ আরো অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানি করি; কিন্তু, পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সক্ষমতা আমরা কখনো প্রকাশ করতে পারিনি।
মিয়ানমারের সঙ্গে একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে আমরা কোথাও পৌঁছাতে পারিনি। যদিও, বর্তমান সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুকে নিজেদের ঘাড়ে বোঝা হিসেবে গ্রহণ করার ভেতর দিয়ে ভিন্ন মাত্রার একটি পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে বলে, আপাত প্রতীয়মান হচ্ছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বর্তমান নেতৃত্বে্র নির্দেশেই রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন নেমে এসেছিল। এই সামরিক বাহিনী প্রধানই আজকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। এই ব্যক্তির নির্দেশেই রোহিঙ্গা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ছাড়াও প্রায় ৯০টি ভিন্ন জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে বসবাস করে। এদের সবাইকে একত্রিত করে; একটি বৃহৎ সামাজিক ঐক্য গড়া, সুদীর্ঘ সময়ের কাজ। সঙ্গে দেশটিকে সামরিক বাহিনীর শাসনের হাত থেকে বের করে আনাও অপরিহার্য ছিল। কিন্তু, সু চি বড় কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পুরোই ব্যর্থ হন। বরং গত নভেম্বরে করোনা চলাকালীন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে মারাত্মকভাবে বিক্ষুব্ধ হলো সেনাবাহিনী।
এ নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক পরাজয় ঘটেছে। সেনাবাহিনীর এতে আশংকা হয়েছে পার্লামেন্টে আর বুঝি তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে না। এতে সেনা সদস্যদের আসন বিলুপ্ত হওয়ার অবস্থাও তৈরি হয়েছে।
৬৪ বছরের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লিয়াং ক্ষমতা দখলের সময় তাই সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই দুর্বল করা চলবে না। সেনাবাহিনী গত পাঁচ দশক ধরে দেশের নানা রাজনৈতিক পক্ষ এবং স্বাধীতাকামী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংঘর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কাজেই সু চি সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য নির্ধারিত আসন বিলুপ্ত করা সম্ভবও ছিল না। তবে একের পর এক গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এনএলডি' জিততে থাকলে একসময় সেনা নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাবে, তেমন ঝুঁকিও তৈরি হয়। আর মূলত সেকারণেই গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থান।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক