প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যাঘাত, থাকবে দীর্ঘ- মেয়াদী প্রভাব
মহামারির কারণে অর্থ সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় ১৫ লাখ শিশুর শিক্ষা জীবন এখন অনিশ্চিত।
শিক্ষা জীবনের পরবর্তী ধাপে পা রাখার আগে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য। দক্ষ জাতি গঠনে শৈশবেই শিশুর জ্ঞান ও মেধার যথাযথ বিকাশ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাহত হলে, শিশুর ভবিষ্যত জীবনে পড়তে পারে দীর্ঘ-মেয়াদী প্রভাব।
বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় সরকারকে শিক্ষাবিদ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলিত ভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্মিলিত পরিকল্পনার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা করোনা পরবর্তী সময়ে পাঠদানের ক্ষতি সামলে নিতে পারবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, "প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের শক্ত ভিত তৈরি করে। তবে বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু হবার পর কখনোই তা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। এমনকি, মহামারিতে অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করলেও, প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের পাঠদান গত মার্চ থেকেই বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে শিশুদের শিখন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, কীভাবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণ হবে, সে সম্পর্কে সরকার এখনও পরিকল্পনা করেনি।
"সরকারি তথ্যানুসারে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০, তবে প্রকৃত অনুপাত এর চাইতেও বেশি। এ পর্যায়ের শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত সর্বোচ্চ ১:২০ থাকা উচিত," যোগ করেন তিনি।
করোনার সময় শিক্ষাখাতে দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলো সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে তারা। এমনকি, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের বেতনও দিতে পারছে না।
এদিকে অন্তত দুই হাজার এলিমেন্টারি স্কুল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলেও মিলছে না কোনো সমাধান। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে আরও দেরি করলে এই সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়াবে বলছে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন।
গত বছর মার্চে সরকার দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা দেওয়ার আগে রাজধানীর মাটিকাটার ইন্সপায়ার স্কুলে ১৫০ জন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থী ছিল। গত বছর থেকেই এই শিশুরা পাঠদান থেকে বঞ্চিত। এই বছর স্কুলটি মাত্র ২৫ জন শিশুকে নতুন বই দিয়েছে। বাকিদের সাথে প্রতিষ্ঠানটির যোগাযোগ নেই। অধিকাংশ অভিভাবকই শিশুদের স্কুলে পাঠাতে অনিচ্ছুক।
স্কুলটির কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরজুড়েই শিক্ষার্থী সংকট থাকলে তারা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ ২০১৩ সালে প্রাক-প্রাথমিক পাঠদান শুরু করে। সকল সরকারি এবং বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলেই এখন প্রি-স্কুলিং এর ব্যবস্থা আছে।
ইউনিসেফের মতে, মানসম্মত প্রাক প্রাথমিক পাঠদান, শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর এবং ফলপ্রসূ করে তুলতে সাহায্য করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাড়াতে এ এক কার্যকর কৌশল।
শৈশবের শুরুতে যথাযথ শিক্ষাদানের ব্যর্থতা শিশুদের পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
ইউনিসেফ বলছে, অসমতা কমাতে, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য দক্ষ মানব সম্পদের দরকার। কিন্তু যথাযথ শিশু শিক্ষার অভাবে জাতি গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পদ হারিয়ে ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে ফেলে।
করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত কিন্ডারগার্টেন
২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজধানীর রামপুরার ইকরা আইডিয়াল স্কুল বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু মহামারির আঘাতে প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
স্কুলটির আটজন শিক্ষককেই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করতে হয়। তারা এখন বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের মাধ্যমে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এ ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না।
প্রতিষ্ঠানটির কোনো সংকটকালীন পুঁজি ছিল না। স্কুল পরিচালনাতেই সমস্ত অর্থ ব্যয় হত। ফলস্বরূপ মহামারি আঘাত হানার পর তারা ব্যয়ভার বহন করতে পারেনি। এখন আর স্কুল পুনরায় খোলার সম্ভাবনাও নেই।
স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক কামরুজ্জামান দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আমি গত বছর মার্চ ও এপ্রিলে দুই লাখ টাকা হারাই। এরপর পুরোপুরি স্কুল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। স্কুলের ব্যয়ভার বহন আমার সামর্থ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। "
ইতোমধ্যে অন্তত ১৫ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বাকিরাও চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন।
পাশাপাশি, দেশে করোনার প্রভাব আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষক তাদের পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হবে।
দেশে ৪০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেনেব প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী এবং আট লাখ শিক্ষক রয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অধিকাংশ স্কুল তাদের কার্য পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান স্কুল খোলার আশায় নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। কিন্তু সেরকম হয়নি। এরপর তারা আর খরচ সামলাতে পারেনি।"
"স্কুল মালিক এবং শিক্ষক উভয় পক্ষই যে শোচনীয় অবস্থায় আছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। অনেকে ইতোমধ্যে তাদের পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছে। আবার অনেকে তাদের স্কুলকে দোকান, লন্ড্রি এবং অন্যান্য ব্যবসায় কাজে লাগিয়েছে।"
এদিকে, কিন্ডারগার্টেন থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এ বছর নতুন বই পেয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের চিত্র সবথেকে হতাশাজনক।
কমেছে ভর্তির হার
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং কলেজ ঐক্য পরিষদের প্রেসিডেন্ট ইকবাল বাহার চৌধুরি বলেন, " কিন্ডারগার্টেনে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির হার অনেক কম। বেসরকারি স্কুল এবং কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে।"
"কিন্ডারগার্টেন মালিকেরা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে। মহামারি চলতে থাকলে বিনিয়োগের অধিকাংশ টাকাই জলে যাবে," বলেন তিনি।
বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের সহায়তায় নেই কোনো পরিকল্পনা
মহামারী চলাকালীন গত জুনে নন-এমপিও ৮১ হাজার শিক্ষক এবং ২৫ হাজার কর্মচারীর জন্য ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছিল সরকার। প্রত্যেক শিক্ষককে ৫,০০০ টাকা এবং প্রত্যেক কর্মচারীকে ২,৫০০ টাকা এক-কালীন হিসাবে প্রদান করা হয়।
তবে শিক্ষকদের সংখ্যা এবং টাকার পরিমাণে অনুদান এতো নগণ্য যে, তা শোচনীয় অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না বলেই অভিমত শিক্ষকদের।
গত ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এবং কলেজ ঐক্য পরিষদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আহ্বান জানায়।
শিক্ষক এবং কর্মচারীদের বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের আর্থিক সহযোগিতা করার দাবিও জানানো হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এই মুহূর্তে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পরিচালনায় সরকার সফট লোন বা, মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দিয়ে সহায়তা করতে পারে বলে অভিমত জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দীকুর রহমান।