উন্নয়ন প্রকল্প ভাগ্য পরিবর্তন করে দিচ্ছে চট্টগ্রামের আবাসন ব্যবসার
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পূর্ব নাছিরাবাদ এলাকায় 'আপন নিবাস' নামের আবাসিক প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রামে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু হয়েছিলো ১৯৮৫ সালে। ৩ যুগ পর এই ব্যবসা চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে উপজেলা পর্যায়েও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
মিরসরাই ইকোনোমিক জোন, কর্ণফুলী টানেল, বে টার্মিনাল, সমুদ্র তীর ঘেঁসে রিং রোডসহ নানা অবকাঠামো নির্মানের ফলে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ব্যাপ্তি ঘটছে উপজেলা পর্যায়েও। চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে উপজেলামুখী হচ্ছে রিয়েল এস্টেট কোম্পানীগুলো।
পাশাপাশি স্থানীয় কোম্পানীগুলোও উপজেলা সদরে বাস্তবায়ন করছে আবাসিক প্রকল্প। আগামী ১০ বছরে এই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ চারগুন বাড়বে বলে মনে করছেন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
২০১৩ সালের দিকে আবাসন ব্যবসায়ে মন্দার পর চট্টগ্রামকেন্দ্রিক সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার কারনে মন্দা কাটিয়ে সমৃদ্ধি আসতে শুরু করে এই ব্যবসায়।
আবাসন ব্যবসার বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাইকে ঘিরে। এই অঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার একর জায়গা জুড়ে নির্মান করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর। এখানে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এই শিল্প নগরের আশপাশে ইতোমধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করেছে আবাসিক প্রকল্প।
অন্যদিকে কর্ণফুলী টানেলের কারণে চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছে শিল্প এলাকা আনোয়ারা উপজেলা। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবসা কর্মসংস্থান। এই টানেলকে ঘিরেও গড়ে উঠছে হাউজিং প্রকল্প।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রিহ্যাব সদস্যভুক্ত ৮৩ টি কোম্পানি চট্টগ্রাম শহরে বর্তমাসে বাস্তবায়ন করছে ২৫০ টি আবাসিক প্রকল্প। এতে ৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এসব প্রকল্পে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার ফ্ল্যাট তৈরী হবে। চলতি বছর কিংবা আগামী বছরের মধ্যে এসব ফ্ল্যাট গ্রাহকদের মধ্যে হস্তান্তর করা যাবে।
রিহ্যাব চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'চট্টগ্রামে যেভাবে শিল্পনগরসহ মেগা প্রকল্প গড়ে উঠছে তাতে আবাসন ব্যবসা উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরী হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড, হাটহাজারী এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, আনোয়ারা, পটিয়া উপজেলাকে আমরা উপযুক্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করছি। কারন বিদেশি অনেক লোক এসব শিল্প কারখানায় চাকরি নিয়ে বাংলাদেশে আসবে। ফলে এসব এলাকায় আবাসন ব্যবসার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে'।
তিনি আরো বলেন, '২০২০ সালে বাংলাদেশে করোনার সংক্রমন শুরু হলে মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত এই ব্যবসা ৪০ ভাগে নেমে আসে। তবে ২০২১ সালের শুরুতে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বর্তমানে ব্যবসা ৯০ ভাগ'।
রিহ্যাব চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সদস্য আবদুল গাফফার মিয়াজী বলেন, 'চট্টগ্রামকে ঘিরে যেভাবে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ার কারণে ফ্ল্যাটের চাহিদা বাড়ছে। সেই সাথে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়ছে। মিরসরাইতে শিল্পনগরের কারনে মিরসরাই ও সীতাকুন্ডে এবং কর্ণফুলী টানেলের কারনে দক্ষিন চট্টগ্রামের আনেয়ারা, পটিয়া উপজেলায় আবাসন খাতে নতুন করে বিনিয়োগের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে ঘিরে আমরা আবাসন ব্যবসার উজ্জল ভবিষ্যৎ দেখছি'।
তিনি আরো বলেন, 'চট্টগ্রামকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারনে চট্টগ্রাম শহরের ব্যাপ্তি আরো বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সেটি করা গেলে অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। আবাসন ব্যবসায়েও বিনিয়োগ বাড়বে'।
র্যাংকস এফসি প্রোপার্টিজ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানভীর শাহরিয়ার রিমন বলেন, 'শিল্পায়নসহ যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে চট্টগ্রাম বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রিয়েল এস্টেট খাতটি আগামী ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে চট্টগ্রামে রিয়েল এস্টেট সেক্টরের জন্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা'।
তিনি আরো বলেন, 'চট্টগ্রামে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার যে সক্ষমতা ইতোমধ্যে তার মাত্র ২০ শতাংশ বিকাশ হয়েছে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এই সেক্টর আরো বিকশিত হবে বলে আমার বিশ্বাস'।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহিনুল ইসলাম খান বলেন, 'আবাসিক প্রকল্পগুলো কোন এলাকায় সম্প্রসারণ করা যায় তা নির্ণয় করতে সিডিএ নতুন করে মাস্টার প্ল্যান করছে। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া নগরীর হালিশহর, হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিনে আনোয়ারা, সীতাকুন্ড, মিরসরাইতে নতুন আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। নাগরিক সুযোগ সুবিধা বাড়ানো গেলে আবাসিক প্রকল্প উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করার সুযোগ রয়েছে'।
এদিকে চট্টগ্রাম শহরের পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও আবাসিক এলাকা গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেছে ডেভেলপার কোম্পানীগুলো। সেই সাথে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় উদ্যোগে গড়া বেশ কিছু রিয়েল এস্টেট কোম্পানী।
মিরসরাইয়ের আবাসন খাতের উদ্যোক্তা শামছুল আলম দিদার বলেন, 'আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে মিরসরাই পৌরসদরে ওয়েস্টার্ন টাওয়ার নামে ৭ তলা বিশিষ্ট একটি আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। ইকোনোমিক জোনে নিয়োজিত দেশি বিদেশী কর্মকর্তাদের কারণে আবাসিক প্রকল্পের চাহিদা রয়েছে। সে কারনে মিরসরাই স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরো একটি আবাসিক প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এখানে আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে।
একাধিক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, চট্টগ্রামে এই ব্যবসার শুরুতে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশি, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, নাসিরাবাদ প্রোপার্টিজ, এমএম আলী রোড, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশসহ কিছু নির্দিষ্ট এলাকাকে ঘিরে আবসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন হতো। গত ৫ বছর ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কথা চিন্তা করে কোম্পানীগুলো শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। যেখানে ৫০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ পাচ্ছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ডেভেলপার কোম্পানী স্যানমার প্রোপার্টিজের জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজুল বারী বলেন, 'শহরের বাইরে উপজেলা পর্যায়ে প্রকল্প সম্প্রসারনের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। এর মধ্যে সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারীতে চলছে আবাসিক প্রকল্পের কাজ। যেখানে সর্বানিম্ন ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ পাবে প্রাহকরা। আগামী ৫ থেকে ৮ বছরের মধ্যে আবাসন আবাসন প্রকল্পগুলো উপজেলা এবং পৌরসভা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ শুরু করেছে স্যানমার প্রোপার্টিজ। মিরসরাই, সীতাকুন্ড, আনোয়ারসহ যেসব এলাকায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে সেসব এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে জায়গা খুঁজছে স্যানমার। এসব এলাকায় ৩০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৭০ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট হস্তান্তরের পরিকল্পনা আছে'।
তিনি আরো বলেন, স্যানমার প্রোপার্টিজ আগামী ১০ বছরের মধ্যে ২ হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এতে প্রায় ১ হাজার ২ শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে স্যানমার প্রোপার্টিজ। স্যানমার প্রোপার্টিজ গত ২০ বছরে ১৮০০ এপার্টমেন্ট হ্যান্ডওভার করে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১৭০০ টি। বর্তমানে স্যানমার প্রোপার্টিজ এর ৩০ টি প্রকল্পের কাজ চলছে।