অতীতের টিকাদান কর্মসূচির শিক্ষা যেভাবে চলমান মহামারি প্রতিরোধে জয় আনতে পারে
"টিকাটি নিরাপদ, কার্যকর এবং শক্তিশালী"- ১৯৫৫ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী জোনাস সালক আবিষ্কৃত পোলিও ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে ঠিক একথাটিই বিশ্ববাসীকে জানানো হয়েছিল। সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক উচ্ছ্বাসের জন্ম নেয়, গির্জায় ঘণ্টাধব্বনি করে অনেক দেশে চলে উদযাপন, দৈনিক পত্রিকাগুলো বড় অক্ষরে ছাপে প্রধান শিরোনাম করে।
আন্তরিক ওই স্বস্তির অনুভূতি আমরা বর্তমান যুগের বাসিন্দারাও অনুভব করতে পারি। কারণ, করোনাভাইরাস অতিমারি যখন ২৫ লাখ জীবন কেড়ে নিয়েছে, তখন কার্যকর ভ্যাকসিনেরই অপেক্ষা করছিলেন বিশ্ববাসী। সেই অপেক্ষার অবসান হয়েছে অনেকটা একই রকম উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। দেশে দেশে চলছে টিকাদানের উদ্যোগ।
আধুনিক যুগে ধনী ও উন্নত দেশগুলো অতীতের ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির আতঙ্ক প্রায় ভুলতেই বসেছিল। তাই টিকা আসার আগে এসব দেশের বাসিন্দারা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারা বুঝতে পারছিলেন, ধনী- দরিদ্র নির্বিশেষে কোভিড-১৯ কাউকেই ছাড় দেয় না।
উন্নত দেশের বাসিন্দা হিসেবে এখন আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং অগ্রসর চিকিৎসা পদ্ধতির কল্যাণে; অতীতে পোলিও, হাম বা স্মলপক্সের জীবাণুর বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে জয় পেতে কয়েক যুগ সময় লেগেছিল- তা মাত্র কয়েক মাসেই অর্জন করা সম্ভব হবে। তবে স্যালকের ভ্যাকসিন আবিষ্কারে যারা উৎফুল্ল হয়েছিলেন তারা অচিরেই বুঝতে পারেন, কার্যকর টিকা বাজারে আসা কেবল শুরুমাত্র। কোনো সংক্রামক ব্যাধি সফলভাবে মোকাবিলার এই লড়াই বরং নতুন মাত্রা পায় টিকাদান চালানোর নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে। শিক্ষাটি আমাদের যুগেও সমান প্রযোজ্য।
পোলিও আর করোনার জীবাণু একেবারেই ভিন্ন ধরনের। পোলিওমেলাইটিস প্রধানত রোগীর মলমূত্র বা সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার প্রধান উৎস শ্বাস-প্রশ্বাস নালী থেকে নির্গত তরল অণুকণা। প্রথম রোগের জীবাণুটি ছোট শিশুদের বেশি আক্রান্ত করে এবং তাদের স্নায়ু ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ কোভিডের প্রধান শিকার মূলত অপেক্ষাকৃত বয়োবৃদ্ধ জনগোষ্ঠী। পোলিও বিশ্বমারির জন্ম দেয়নি, অর্থনীতিতেও ধস নামায়নি। বৈশ্বিক সংক্রমণ অনেকগুণ কম থাকা সত্ত্বেও পোলিও নির্মূলে প্রায় সকল দেশে যে ব্যাপক আকারের টিকাদান চালানো হয়; তা মূলত ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা এবং অতি-ভীতি থেকে প্রভাবিত। একমাত্র পোলিও টিকার উদ্যোগকেই বর্তমানের টিকাদানের মহাচেষ্টার কাছাকাছি পর্যায়ে তুলনা করার জন্যে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
পোলিও' টিকাদানের সেই অতীত ইতিহাসেই আছে সুসংবাদ। পোলিও নির্মূলের সফলতা আমাদের অতি-বাস্তব সম্ভাবনার পথ দেখায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক জোট হলে যে কোনো মহাব্যাধি দূর করা সময়ের ব্যাপার মাত্র হয়ে পড়ে, সেই শিক্ষাই দেয় পোলিও'র সফল টিকাদান।
তবে অন্যকিছু শিক্ষাও আছে। যেমন; আমরা জানি বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষায় প্রমাণিত টিকায় আস্থা রাখা যায়। আবার টিকা উৎপাদন, বন্টন ও সমতার ভিত্তিতে সরবরাহে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবের মতো বেদনাদায়ক ভুলটি পোলিও নির্মূলের চেষ্টাকে অনেক বিলম্বিত করে। বর্তমান সফলতাও আসবে অতীতের সে ভুলটি না করলেই। অর্থাৎ, জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। অতীতে অনেকেই টিকায় আস্থা রাখেননি, সে অবিশ্বাস কোভিডের ক্ষেত্রে বরং অনেক বেশি। তাকে মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয় এবং রাজনৈতিক ঐক্যও অনেক বেশি দরকারি।
পোলিও সংক্রমণের রেকর্ড বহু শতাব্দী প্রাচীন। এমনকি প্রাচীন মিশরেও রোগটির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানা যায়। তবে কেবলমাত্র ১৯ শতকের ঊষালগ্নে এটি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাদুর্ভাবের আকারে ছড়াতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রাদুর্ভাবটি দেখা দেয় ভারমন্টে ১৮৯৪ সালে। তারপর দেখা দেয় অন্যান্য অঞ্চলেও। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ১৯১৬ সালের গ্রীষ্মে নিউইয়র্ক রাজ্যে। দেখা দেয় মৃত্যুর অবাধ লীলা, সংক্রমণ বন্ধে চালু হয় লকডাউন। জীবাণু বাহক সন্দেহে মেরে ফেলা হয় সব ভবঘুরে বেড়াল। ১৯৫২ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে বাৎসরিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পোলিও সংক্রমণের ঘটনা রেকর্ড করা হয় প্রায় ৬০ হাজার।
অথচ, তখন ক্যান্সার বা দুর্ঘটনায় এর চাইতে অনেকগুণ বেশি শিশু মারা যেতো। তবুও, সংক্রামক ব্যাধিতে প্রিয় সন্তানের প্রাণহানি বা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ার ঝুঁকি সকল অভিভাবককেই ভীত-সন্ত্রস্ত করে রাখে। সেযুগের প্রযুক্তিতে তৈরি পোলিও রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে উদ্ভাবিত 'আয়রন লাংস' নামক বিশাল যান্ত্রিক ফুসফুসের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ভীতিকে রুপ দেয় প্রবল আতঙ্কে। আর পঙ্গু শিশুদের পায়ে খাঁচাসদৃশ কাঠামো সবাইকে নির্বাক করে দিয়েছিল। ১৯৫০ এর দশক নাগাদ পোলিও'র চাইতে কেবলমাত্র পরমাণু বোমাকেই বেশি ভয় পেতো মার্কিনীরা।
সেই ভীতি অবসানে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের মতো তৎপরতার দরকার হয়। ১৯২১ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট নিজেও পোলিও সংক্রমিত হয়েছিলেন। তার উদ্যোগেই একটি পুনর্বাসনমুলক দাতব্য সংস্থাকে একটি নজিরবিহীন জাতীয় কার্যক্রমে রুপ দেওয়া হয়। এই প্রচারনায় প্রভাবিত হন প্রায় সকল মার্কিনী। প্রত্যেকেই অন্তত একটি মুদ্রা দান করেন সে তহবিলে। অনেকেই এত বিপুল অর্থ পাঠান, যার হিসাব রাখতেই ঘাম ছুটে যায় হোয়াইট হাউজের কর্মকর্তাদের। ১৯৩৮ সাল নাগাদ এই উদ্যোগের আওতায় গড়ে ওঠে শত শত মিলিয়ন ডলারের এক জাতীয় পোলিও তহবিল।
তারপর আসে সফলতা। সরকারি অর্থের সহযোগিতায় সকলকে পেছনে ফেলে প্রথম পোলিও'র নিষ্ক্রিয় ধরনের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী সালক। জনতা তাকে প্রাণ খুলে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু, তার সমকালীন অন্য বিজ্ঞানীরা তার টিকাটি নিয়ে শতভাগ সন্তুষ্ট ছিলেন না। মাত্র কয়েক বছর পরেই তার এক প্রতিদ্বন্দ্বী আলবার্ট সাবিন আবিষ্কার করেন ভিন্ন ধরনের একটি সক্রিয় জীবাণু ভিত্তিক প্রতিষেধক, যা মুখে দিয়ে খাওয়ানো সম্ভব। তাদের দুই জনের এই দ্বিপাক্ষিক চেষ্টাতেই শেষকালে পোলিও সংক্রমণের সংখ্যা বহুগুণ কমে আসে।