মহামারিতেও প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে চমক
মহামারির প্রভাবে দেশের সিংহভাগ রপ্তানি নির্ভর শিল্প যখন রপ্তানি কমেছে, ঠিক তখনই ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছে প্রকৌশল খাত। এমনকি গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ৫৭.৬৪ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এই খাত।
গত তিন বছর ধরে টানা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর রপ্তানির এই উত্থান দেখা গেছে মহামারির বছরে!
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি'তে মেয়াদে প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২,৮৭৬.৫০ কোটি টাকা। এই সময়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১,৯৯০ কোটি টাকা, কিন্তু ৮ মাসে হয়েছে ৪৪.৫৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এখাতের রপ্তানি আয় ছিল ১,৮২৪ কোটি টাকা।
প্রকৌশল খাতের রপ্তানি বৃদ্ধি, বিশেষ করে হালকা প্রকৌশল (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং) খাতে আসা অগ্রগতিকে আশাব্যঞ্জক বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের দেওয়া নগদ প্রণোদনার কল্যাণেই হালকা প্রকৌশল খাতে উত্থান দেখা দিয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি'র (ডিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট রিজওয়ান রাহমান। এই প্রণোদনা আগামী অর্থবছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, "শিল্প মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে হালকা প্রকৌশল খাতকে বছর সেরা শিল্প বলে ঘোষণা দেয়। স্বীকৃতিটি বিনিয়োগকারিদের আস্থা বাড়ায়, যার ফলে অনেক ব্যবসায়ী এখন এই খাতের উন্নয়নে কাজ করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন।"
এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং'কে বর্ষসেরা শিল্প পণ্যের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে, এখাতের রপ্তানিতে ১৫ শতাংশ নগদ অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেয় সরকার।
ইপিবি'র তথ্যানুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বাড়ে। তারপরেই টানা তিন বছর নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির চক্রে পড়েছিল খাতটি।
বছরওয়ারি হিসেবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৮.৩২ শতাংশ রপ্তানি আয় কমে। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কমে ৪.১২ শতাংশ। গেল অর্থবছর অর্থাৎ, ২০১৯-২০ কমেছিল ছিল ১৪.১৮ শতাংশ।
রপ্তানি পণ্য ও গন্তব্য:
ইপিবি'র মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি করছে, তার মধ্যে আছে; আয়রন-স্টিল, তামার তার, স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি সামগ্রী, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি, ইলেকট্রিক পণ্য, বাইসাইকেল এবং অন্যান্য পণ্য।
এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে; ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রিটেন, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, চীন, মিয়ানমার, ইতালি, পর্তুগাল, কোরিয়া, চাদ, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, গ্রীস, কুয়েত, কেনিয়া, নেপাল, তিমুর, ইয়েমেন, ফ্রান্স, হংকং, শ্রীলঙ্কা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, জার্মানি, আলজেরিয়া, মিশর, স্পেন, হন্ডুরাস, এস্তোনিয়া, নেদারল্যান্ডস এবং চিলি'তে।
তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আয়রন-স্টিল রপ্তানি বেড়েছে ৮২.৩৯ শতাংশ। তামার তার রপ্তানি বেড়েছে ৩২.৪৩ শতাংশ, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ৬৯.৭৬ শতাংশ, ইলেকট্রিক পণ্য ৪০.৭০ শতাংশ, বাইসাইকেল ৪০.৯০ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতের মোট ১০৮.৮৬ শতাংশ।
জুলাই-ফেব্রুয়ারির একইসময়, স্টেইনলেস স্টিল সামগ্রী রপ্তানি কমেছে ৩৩.৬৬ শতাংশ।
মহামারিতে বেড়েছে বাইসাইকেলের চাহিদা:
বাইসাইকেল-সহ নানা ধরনের সাইকেল রপ্তানি হচ্ছে; অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন, ফিনল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, পোলান্ড, পর্তুগাল, সুইডেন, স্লোভাকিয়া, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্রসহ- ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের বেশকিছু দেশে।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় হয় ৩৭৮.০৭ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ১৭৮.৩১ কোটি টাকা আয় হয় যুক্তরাজ্যের বাজার থেকে। তারপরেই, দ্বিতীয় শীর্ষ আয় উৎস ছিল জার্মানি, সেদেশে বাইসাইকেল বিক্রির আয় হয়েছে ১১৫.৯৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে তৈরি বাইসাইকেল ২০১৫ সাল থেকে ১০টি দেশের বাজারে রপ্তানি করছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল- টিবিএস'কে বলেন, করোনাকালে গণপরিবহণ এড়িয়ে চলার কারণে বিশ্বব্যাপী বাইসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। "অনেকেই এখন অফিস করার জন্যে বাইসাইকেল কিনেছেন।"
এখাতের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকার নীতিমালা সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে বিদেশ থেকে বাইসাইকেল আমদানি নিরুৎসাহিত করলে স্থানীয় বাজারে দেশে তৈরি বাইসাইকেলের চাহিদা দ্বিগুণ হবে।
১০ হাজারের বেশি পণ্য:
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি'র মতে, সারাদেশে তাদের ৫০ হাজার কারখানায় কর্মরত আছেন ছয় লাখ দক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিক। এখাতে আরও ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
দেশের মোট উৎপাদিত পণ্য বা জিডিপি'তে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে প্রায় ১০ হাজারের বেশি রকমের পণ্য উৎপাদনকারী খাতটি।
বাংলাদেশে প্রকৌশল খাতে এপর্যন্ত বিনিয়োগ করা হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা বা ১৪.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া, স্থানীয় বাজারে এর পণ্য ও পরিষেবার বিক্রি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
তবে শিল্পটির সম্ভাবনা বিপুল। কারণ বিশ্ববাজারে এখাতের বাজার পরিধি ৮ লাখ কোটি ডলার।