ঝড়-ঝঞ্ঝায় ‘মায়ের মতো আগলে রাখে’ সুন্দরবন
প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত কাটতে না কাটতেই আবারও মায়ের আঁচলের মতো বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করেছে সুন্দরবন।
বাঘের মতো তর্জন-গর্জন করে গত শনিবার বিকালে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল প্রথমে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে আঘাত হানে। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে এটি বাংলাদেশের পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার চরে ঢুকে পড়ে।
দুই দেশের সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে দুর্বল ‘বুলবুলের’ কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার কমে যায়। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলাগুলোতে গত শুক্রবার বেলা ১২টার পর থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শনিবার বিকালের পর থেকেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবনের দুবলার চরে আঘাত হানার পর থেকেই ধমকা হাওয়ার সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হয়।
সুন্দরবন উপকূলকে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়ার হুমকি নিয়েই ধেয়ে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে সরকারের নানা তোড়জোড় এবং সর্বাত্মক প্রস্তুতি ছিল। নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল সুন্দরবন উপকূলের ৫ লক্ষাধিক মানুষকে। প্রস্তুত ছিল ১০টি যুদ্ধজাহাজ। সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা, উদ্ধার তৎপরতা ও জরুরী ত্রাণ বিতরণের জন্য প্রস্তুত ছিল সেনাবাহিনী। খুলনাসহ উপকূলীয় জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটিও বাতিল করা হয়।
খুলনা জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ জানান, শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সুন্দরবন উপকূলে প্রথম আঘাত হানে। রাত তিনটার দিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও কয়রা অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের দিকে ধাবিত হয়। ভোর পাঁচটার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি ৬০ কিলোমিটার বেগে খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট ও পিরোজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। তবে নদীতে জোয়ার না থাকায় আইলার মতো জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটেনি নেই।
এদিকে, পূর্বাভাসে যতটা ‘গর্জন’ ছিল, বাস্তবে ততটা বর্ষেনি ‘বুলবুল’। উপকূলের ২০০ কিলোমিটারে প্রবেশের পথে শক্তি কমতে থাকে। স্থলভাগে ‘ছোবল’ মারার সময় ঘূর্ণিঝড়টির গতি আরও কমে যায়।
রোববার সকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়টি খুলনা অঞ্চল অতিক্রম করে ‘স্থল নিম্নচাপ’ পরিচয়ে। তবে বড়ো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের তিন জেলায় গাছ পড়ে কিশোরী ও নারীসহ চার জনের মৃত্যু হয়েছে।
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের উত্তর রামপুরা গ্রামে ঝড়ো বাতাসের তোড়ে ঘরের উপর গাছ চাপা পড়ে হামেদ ফকির (৬৫) নামের এক বৃদ্ধ মারা গেছেন বলে মির্জাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিশ্চিত করেছেন।
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় সকালে গাছ পরে আলমগীর হোসেন (৪০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন দিঘলিয়া থানার ওসি মল্লিক মোর্শেদ।
একই জেলার দাকোপ উপজেলায় প্রমিলা মণ্ডল (৫২) নামে এক নারী গাছ চাপা পড়ে মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আব্দুল ওয়াদুদ।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভরসাপুর গ্রামে সকালে বাড়ির ওপর গাছ পরে খাতুন (১৫) নামে এক কিশোরী নিহত এবং আরও দুজন আহত হয়েছেন।
মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় জানান, পরিবারের সদস্যরা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের চার ঘণ্টার তাণ্ডবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ ও কয়রার তিন সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং গাছপালা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।
খুলনা জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ও কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম জোয়ার্দার বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে কয়রা উপজেলায় ১ হাজার ৫ শত ও দাকোপ উপজেলায় ১ হাজার ৭ শতসহ খুলনা জেলায় তিন সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া বহু গাছপালা উপড়ে ও ভেঙ্গে গেছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) বসিরুল আল মামুন বলেন, সুন্দরবন প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলাসহ বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ছোবল থেকে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদকে রক্ষা করেছে। এবারো মায়ের আঁচলের মতো বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করেছে সুন্দরবন। এই সুন্দরবনকে রক্ষা করা উপকূলীয় এলাকার মানুষসহ দেশবাসীর দায়িত্ব।
তিনি বলেন, সুন্দরবন বেঁচে থাকলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাবে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূল অঞ্চলের মানুষ ও সম্পদ।