বিটুমিন আমদানিতে শুল্কহার বাড়াতে চায় ট্যারিফ কমিশন
বিটুমিন শিল্পের দেশীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দিতে সেফগার্ড হিসেবে আমদানি করা বিটুমিনের ওপর শুল্কহার বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে পাঠানো প্রতিবেদনে, ড্রামে আমদানি করা বিটুমিনে ৪৭ শতাংশ এবং বাল্কে আমদানি করা বিটুমিনের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া বিটিটিসির প্রতিবেদনের বলা হয়, আমাদানিনির্ভর এই খাতে একমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। যদিও প্রতিষ্ঠানটির বাই প্রোডাক্ট হিসেবে বিটুমিন উৎপাদন হয়, যার বার্ষিক পরিমাণ ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় অতি সামান্য।
এ অবস্থায় বিটুমিনের বাজারে উৎপাদনকারী হিসেবে এ বছরই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। তবে আমদানি করা বিটুমিনের দাম স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনের চেয়ে কম। ফলে স্থানীয় এই শিল্পকে যেন ক্ষতির মুখে পড়তে না হয়, সে কারণে আমদানি করা বিটুমিনের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।
এই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিদেশ থেকে কাঁচামাল এনে স্থানীয়ভাবে পরিশোধন করার পর প্রতি টন বিটুমিনের উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ২৮৯ টাকা। আর প্রতি ড্রামের (১৫০ কেজি) মূল্য ৮ হাজার ৬৪০ টাকা।
অন্যদিকে, বাল্কে আমদানি করে আনা প্রতি টন বিটুমিনে শুল্ক কর পরিশোধের পর দাম পড়ে ৪১ হাজার ৭৩৯ টাকা এবং প্রতি ড্রামের (১৫০ কেজি) দাম পড়ে ৫ হাজার ৬৪৮ টাকা।
জানা গেছে, বিটুমিনাস ক্রুড থেকে বিটুমিন উৎপাদন হয়। কাঁচামাল আমদানির ওপর মোট ২৮ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এছাড়া ক্রুড থেকে ৫৮.৪৪ শতাংশ বিটুমিন ও বাই প্রোডাক্ট হিসেবে ৩০.৩৩ শতাংশ ডিজেল, ৯.৭১ শতাংশ ফার্নেস অয়েল ও ১.৫২ শতাংশ নাপথা পাওয়া যায়।
পেট্রোলিয়াম আইন, ২০১৬ অনুযায়ী বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পাওয়া ডিজেল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করতে পারে না। এই ডিজেল বিপিসিকে দিতে হয়।
বিটুমিনের কয়েকজন আমদানিকারকের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, যদি বসুন্ধরার জন্য আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে ক্রেতা ঠকার আশঙ্কা রয়েছে। বাজারে প্রতিযোগিতা কমে গিয়ে মনোপলি বিজনেস হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়াম্যান মো. মফিজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'সরকার যদি শিল্পের সহযোগিতার জন্য আমদানি করা বিটুমিনের ওপর শুল্ক বাড়ায়, তখন বাজারে কী প্রভাব পড়ে, সেটা আমরা দেখব। এখানে যদি মনোপলি শুরু হয়, তখন আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
বিটুমিনের চাহিদা, উৎপাদন ও ব্যবহার
বাংলাদেশে প্রতি বছর বিটুমিনের চাহিদা প্রায় ৫.৫ লাখ মেট্রিক টন। অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছর বাড়ছে এর বাজার। পণ্যটির চাহিদা ১০-১২ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে জানা গেছে।
বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ৪ লাখ টন, যা মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ। সেখানে দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের কাজ চলছে। সেটি চালু হলে উৎপাদনক্ষমতা দাঁড়াবে ৮.৪০ লাখ টনে, যা বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি।
এছাড়া বিপিসি থেকে বছরে ৬০-৭০ হাজার টন বিটুমিন পাওয়া যায়।
জানা গেছে, বাংলাদেশে বিটুমিনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে সড়ক নির্মাণ, বিমানবন্দরের রানওয়ে নির্মাণসহ ফুটপাথ তৈরির কাজে। এছাড়া ট্যাঙ্কের ভেতরে প্রলেপে, নৌকার তলদেশে প্রলেপে, ভারি শিল্পে গার্ডওয়াল নির্মাণকাজে, বিদ্যুৎরোধক হিসেবে, ইন্সুলেটিং টেপ, জলরোধী কাপড়, বার্ণিশ, ওয়েল পেন্ট, বরার ইন্যামলের বিকল্প ও কোল্ডস্টোরেজ, ইলেকট্রনিক ব্যাটারি, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি তৈরির কাজে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়।
বিটুমিন দুটি গ্রেডে উৎপাদন করা হয়- ৮০/১০০ ও ৬০/৭০ গ্রেড। আমদানি হয় বাল্কে ও ড্রামে।
কাঁচামালে আমদানি শুল্ক
বিটুমিন উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর মোট ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক রয়েছে। এ ছাড়া ব্যারেল প্রতি এর ট্যারিফ মূল্য ৪০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা রয়েছে।
বিটুমিন আমদানিতে বর্তমান বিদ্যমান শুল্কহার
ড্রামে পেট্রোলিয়াম বিটুমিন আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি প্রতি মেট্রিক টনে ৪ হাজার ৫০০ টাকা র্নিধারিত। এছাড়া এর ওপর ২ শতাংশ অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) এবং ৫ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্যাক্স (এটি) দিতে হয়। তবে যারা বাল্ক আকারে আমদানি করেন, সে ক্ষেত্রে প্রতি মেট্রিক টনে ৩ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারিত এবং ২ শতাংশ এআইটি এবং ৫ শতাংশ এটি দিতে হয়।
এছাড়া কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ সড়ক গবেষণাগারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনের গুণগতমান ও বাজার থেকে সংগ্রহ করা আমদানির বিটুমিনের মান পরীক্ষা করা হয়। এতে আমদানি করে আনা বিটুমিনের চেয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিটুমিনের মান ভালো বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
বাংলাদেশে যে দুই গ্রেডের বিটুমিন বিক্রি হচ্ছে, এর মধ্যে ৮০/১০০ ও ৬০/৭০ গ্রেডের মধ্যে ড্রামের বিটুমিনের দাম পড়ে ৬৮০০-৭২০০ টাকা এবং বাল্কের বিটুমিন বিক্রি হচ্ছে টনপ্রতি ৩৯৩০০-৪২০০০ টাকা।
- সূত্র: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড