কক্সবাজারে ৩ কোটি টাকার ওয়াইফাই সেবা তেমন কাজেই আসছে না
কক্সবাজারকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা এবং পর্যটন শিল্পের ক্রমবিকাশ ধরে রাখার লক্ষ্যে সরকার 'ফ্রি ওয়াইফাই' সেবা চালু করে ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু চালু হওয়ার পর কিছুদিন ফ্রি ওয়াইফাই সংযোগের সেবা পেলেও গত ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে এ সেবা মিলছে না। ফলে সরকারের এ ওয়াইফাই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পর্যটকসহ স্থানীয়রা।
এ অবস্থায় সরকারের আসল উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে বসেছে বলে আশঙ্কা সচেতন মহলের। অনেকে আবার সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতাকে এ অবস্থার জন্য দায়ী মনে করছেন। একে 'ডিজিটাল প্রতারণা' বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থা আমরা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকে 'ক্ষেত্র বিশেষে ডাটা না থাকার' বিষয়টি স্বীকার করে প্রকল্পটি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ 'কউক' বলছে, এখনো প্রকল্পটি তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)।
জানা যায়, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজারের সৌন্দর্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পের ক্রম বিকাশ ঘটাতে সরকার ২০২০ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নামে 'ফ্রি ওয়াইফাই' সেবা চালু করে। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে ওয়াইফাই সংযোগের পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে 'জয়বাংলা'। তখন জানানো হয়েছিল, একসঙ্গে প্রায় ৮ হাজার ব্যবহারকারী ফ্রি ওয়াইফাই সেবা নিতে পারবেন। এ লক্ষ্যে সৈকত এলাকা ছাড়াও শহরের ৩৫টি জনবহুল স্থানে ৭৪টি বিশ এমবিপিএস হাই স্পিড ব্যান্ডউইথ সম্পন্ন রাউডার স্থাপন করা হয়। যেখানে প্রত্যেকটি রাউডারে ১০০ জন করে একসঙ্গে ওয়াইফাই সেবা ব্যবহার করতে পারবেন বলে প্রচার করা হয়েছিল।
বিসিসির প্রকল্পটি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বাস্তবায়ন করেছে 'আমরা নেটওয়ার্ক কোম্পানিজ লিমিটেড' নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রতি মাসে এমবিপিএস হিসেবে ৬০ হাজার টাকা বিল উত্তোলন করছেন প্রতিষ্ঠানটি। শুরু থেকে এ প্রকল্পের প্রতি পর্যটক ও স্থানীয়দের আগ্রহ থাকলেও ওয়াইফাই ডাটা সংযোগ না পেয়ে হতাশ হয়েছেন তারা।
যেসব এলাকায় ওয়াইফাই পাওয়া যাবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা হলো- সুগন্ধ্যা পয়েন্ট, সায়মন বিচ, লাবণী বিচ, কলাতলী বিচ, বিয়াম ভবন, ডলফিন চত্বর, হোটেল-মোটেল রোড, জাম্বুর মোড়, রূপচাঁদা ভাস্কর্য, সম্পাদক ভাস্কর্য, হলিডে মোড়, প্রেস ক্লাব, পুরাতন স্টেডিয়াম, বার্মিজ মার্কেট, কচ্ছপিয়া পুকুর, সার্কিট হাউস, গোলদীঘি, বনবিভাগ উত্তর ও দক্ষিণ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পাবলিক লাইব্রেরি, দৌলত ময়দান, শহীদ মিনার, জজ কোর্ট, পুলিশ সুপার কার্যালয়, জেলা পরিষদ, হিলডাইন সার্কিট হাউস, হিলটপ সার্কিট হাউস, রাডার স্টেশন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর কার্যালয়, লারপাড়া বাস স্ট্যান্ড, হিমছড়ি ও দরিয়ানগর।
উপকারভোগীদের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজারে চালু হওয়া 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' নামে ফ্রি ওয়াইফাই মোবাইল ফোনে কানেকশন এলেও ডাটা থাকে না। যার ফলে সরকারি এ ওয়াইফাই দিয়ে অনলাইনভিত্তিক কোনো কাজ করা সম্ভব হয় না। এটি এক ধরনের 'ডিজিটাল প্রতারণা'। সংশ্লিষ্টদের তদারকি না থাকা এবং উদাসিনতাকে এ জন্য দায়ী মনে করেন ব্যবহারকারীরা।
কক্সবাজারে বেড়াতে আসা ফেনীর দাগনভূঁইয়ার পর্যটক আকবর হোছাইন (২৮) বলেন, 'কক্সবাজারে ফ্রি ওয়াইফাই চালু করা হয়েছে শুনে ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি, সিগন্যাল আসে, কিন্তু ডাটা আসে না। এটি বিব্রতকর।'
পর্যটন নগরীতে ঘুরতে আসা মাসুদ হোসেন (২৪) নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, 'গত কয়েকদিন ধরে সৈকতের লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্টে নিরিবিলিতে বসে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু সংযোগ পেলেও ডাটা পাইনি। এটি অভিনব প্রতারণা বলে মনে হচ্ছে।'
কক্সবাজার সিটি কলেজের শিক্ষার্থী বিপ্লব মুন্না (২২) বলেন, "বন্ধুরা মিলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঝাউতলা আর হলিডে মোড় এলাকায় আড্ডা দিই। কখনো ডিজিটাল বাংলাদেশ নামের ফ্রি এ ওয়াইফাই ব্যবহার করতে পারিনি। অনেক মোবাইলে ডাটা এলেও স্পিড খুবই বাজে। মূলত সরকারি টাকা লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছে 'আমরা নেটওয়ার্ক' নামে এ প্রতিষ্ঠান।"
আমরা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেডের কক্সবাজারের সহকারী প্রজেক্ট ম্যানেজার হাসানুজ্জামান বলেন, 'উদ্বোধনের পর থেকে অনেক সময় আমরা টেকনিক্যাল কিছু সমস্যায় পড়েছি। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ডাউন হলে এ সমস্যা একটু বাড়ে। বর্তমানে কক্সবাজারে ৬৫টি ডিভাইস সচল রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা নেটওয়ার্কের সঙ্গে বিসিসির এক বছরের চুক্তি শেষ হয়েছে। কাগজে কলমে প্রজেক্টের দায়িত্ব কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছি। কিন্তু এখনো তারা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেনি বলে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।'
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে প্রকল্পটির দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ওয়াসিফ কবির প্রকল্প হস্তান্তরের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, 'বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিসি আমরা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এমবিপিএস হিসেবে প্রতি মাসে ৬০ হাজার টাকা বিল উত্তোলন করে সংস্থাটি। আমরা লোকাল অথরিটি হিসেবে দেখভাল করব। কিন্তু এখনো পর্যন্ত প্রকল্পটি আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। যার কারণে অনেক কিছুই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। তবে ওয়াইফাই সংযোগে ডাটা সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেডকে বলা হয়েছে।'
আমরা নেটওয়ার্ক লিমিটেডের এজিএম মাহমুদুন নবী চৌধুরী বলেন, 'মূলত মোবাইল সেটের ওপর নির্ভর করে এমনটা হচ্ছে। তারপরও কোনো অভিযোগ পেলে তা দ্রুত সময়ে সমাধান করা হচ্ছে।'
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) কর্মকর্তা ও প্রজেক্ট ম্যানেজার মধুসুদন চন্দ্র বলেন, 'তিন কোটি টাকা চুক্তিতে কক্সবাজার এবং সিলেটে ২০০ রাউডার নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আমরা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেডের মেয়াদ শেষ হলে স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরই মধ্যে যদি কোথাও নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা দেয়, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালে তারা সমাধান করবেন।'
সকলের সহযোগিতায় প্রকল্পের সফলতা নির্ভর করবে বলে মনে করেন তিনি।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, 'প্রকল্পটি এখনো আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তাই কোথায় নেট পায় আর কোথায় পায় না- তার সঠিক কিছু বলতে পারছি না। আমাদের কাছে হস্তান্তরিত হলে তখন ভালোমতো দেখভালের দায়িত্ব পালন করা হবে।'