২০২১ সালে কোভ্যাক্সের ২০০ কোটি ডোজ বিতরণকে হুমকির মুখে ফেলেছে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ
চলতি বছরের শেষ নাগাদ স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশে কোভিড ভ্যাকসিনের দুইশ' কোটি ডোজ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। কিন্তু, এই লক্ষ্য অর্জনের পথে কাঁটা হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মতো কিছু দেশের ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদক সংস্থা সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার মুখ্য নির্বাহী আদর পুনেওয়াল্লা এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। পুনেওয়াল্লা জানান, প্রভাবশালী কিছু দেশ নিজেদের টিকা মজুদ কঠোর নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং সীমিত করেছে টিকা উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের সরবরাহ।
হু'র কোভ্যাক্স কর্মসূচির মাধ্যমে এপর্যন্ত যতো টিকা দেওয়া হয়েছে তার অর্ধেকের বেশি সরবরাহ করেছে সেরাম। বিপুল উৎপাদনের মাধ্যমে সংস্থাটি কোভ্যাক্সের বিশাল চাহিদা পূরণের লক্ষ্য নিয়েছে। হু' চায় কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সকল দেশের জন্য সমানভাবে টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। কিন্তু, সেখানেই কট্টর জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেন সেরাম নির্বাহী।
ব্লুমবার্গ ইক্যুয়ালিটি সামিটের অংশ হিসেবে আজ বুধবার (১৭ মার্চ) ব্লুমবার্গ লাইভে সম্প্রচারিত হয় তার সাক্ষাৎকার। সেখানে পুনেওয়াল্লা বলেন, কোভ্যাক্সের চালান গতিশীল হতে এখনও দুই-তিন মাস সময় লাগবে। ফলে ২০২১ সালের মধ্যেই ২শ' কোটি ডোজ বিতরণের লক্ষ্য অর্জন করাটা হয়ে পড়বে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। এমনকি লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হয়ে আরও কয়েক মাস পিছিয়ে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
পুনেওয়াল্লার মন্তব্যে উঠে আসে, ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চলমান বৈষম্য মোকাবিলার চ্যালেঞ্জের দিকটি। মহামারির শুরু থেকেই টিকার চালান অগ্রিম মজুদ করে ধনী দেশগুলো। সেই তুলনায় দরিদ্র দেশ- বিশেষ করে, আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ রাষ্ট্র চলতি মার্চের আগে টিকার একটি ডোজও পায়নি। অথচ, ইসরায়েল, বাহারাইন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী ইতোমধ্যেই টিকার আওতায় চলে এসেছে।
বিশাল জনসংখ্যা থাকার কারণে ভারতে নানান রোগের জাতীয় টিকাদানে ভ্যাকসিনের চাহিদা তৈরি হয়। তাই স্বাধীনতার পর থেকেই আবিস্কারক সংস্থার লাইসেন্স নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে প্রতিষেধকের বৃহত্তম উৎপাদক হয়ে ওঠে ভারত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা চাহিদার অর্ধেকের বেশি পূরণ করে দেশটি রপ্তানির মাধ্যমে। মহামারি হানা দেওয়ার পর কোভিড টিকা উৎপাদন ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত তাই বাড়তি সুবিধা পায় বিদ্যমান অবকাঠামো থেকে। সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ভারত সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোভিড ভ্যাকসিন দাতা ও সরবরাহকারক হিসেবে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ভ্যাকসিন কূটনীতিতে পেছনে ফেলে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকেও। একইসাথে আবার ভ্যাকসিন বিতরণের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে দিল্লি। দেশটির জাতীয় টিকা কর্মসূচির আওতায় দেওয়া সিংহভাগ প্রতিষেধকের ডোজ উৎপাদন করছে সেরাম। স্থানীয়ভাবে কোভিশিল্ড নামে বাজারজাত করা এই টিকার আবিস্কারক সংস্থা হলো- অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
পুনেওয়াল্লা জানান, জাতীয় চাহিদা পূরণে প্রথমে যতোখানি ধারণা করা হয়েছিল, দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা বর্তমানে তার চাইতেও বেশি ডোজ সরবরাহ করার জন্য সেরামকে অনুরোধ করছেন। বাড়তি এই চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই কোভ্যাক্স এবং অন্যান্য দেশে সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
তিনি বলেন, প্রথমে মার্কিনীরা তাদের 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতির আলোকে ভ্যাকসিন সংরক্ষণে নামে, তাই বৈশ্বিক সরবরাহের শূন্যস্থান পূরণ করতে তৎপর হয়েছে চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ।
"প্রথম থেকেই আমরা (সেরাম) উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেই। সিংহভাগ সক্ষমতা বাড়ানোর পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক চাহিদা পূরণ। এখনও আমরা স্থানীয় চাহিদা এবং বৈশ্বিক ঘাটতি পূরণের মাঝে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা করছি। তবে প্রথম কয়েক মাসে উৎপাদিত ভ্যাকসিন দিয়ে ভারতসহ ও অধিক সংক্রমণের শিকার কিছু দেশের চাহিদা পূরণকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।"
ভীতিকর বৈষম্যের চিত্র:
টিকা বিতরণ শুরু করতেই অনেকটা সময় লেগেছে কোভ্যাক্সের, পূর্ণগতিতে সচল হওয়াটাও সময়সাপেক্ষ বলে স্পষ্ট হচ্ছে। হু' মহাসচিব মহাপরিচালক ড. তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস এজন্য বিভিন্ন দেশের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং হু'র অনুমোদনের আগেই আবিস্কারক কোম্পানির সরাসরি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরকে দায়ী করেছেন।
এর বাইরে টিকার কাঁচামাল প্রাপ্তি নিয়েও আছে বিপত্তি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার 'ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট' কার্যকর করে শুধুমাত্র মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্যেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রক্রিয়াজাত কাঁচামাল সরবরাহের নীতি নেয়। অন্যান্য দেশের উৎপাদক সংস্থার সক্ষমতায় যা বড় প্রভাব ফেলবে। এনিয়ে উদ্বেগ পুনঃপ্রকাশ করে পুনেওয়াল্লা বলেন, কাঁচামাল নিয়েও জাতীয়বাদ দেখা যাচ্ছে।
"আমি যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের প্রতি এই বার্তা দিতে চাই- দয়া করে বৈশ্বিক ভ্যাকসিন উৎপাদকদের অতি-প্রয়োজনীয় কাঁচামালের চালান নিষিদ্ধ করবেন না।"