ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক বিপনন ব্যবস্থায় বিরক্ত রোগীরা
২২ অক্টোবর সকাল ১০টা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীর উপচে পড়া ভিড়। পাঁচ বছরের ছেলে কাউসারকে চিকিৎসক দেখিয়ে আউটডোর থেকে বের হয়েছেন সাভারের আনোয়ার মিয়া।
ছেলের হাত ধরে বারান্দায় বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন লোক তাদের ঘিরে ধরেন। তার হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইলে ছবি তুলে নেন। হাসপাতালের আনসার সদস্যরা অনুরোধ করার পর বারান্দা থেকে সরে যান তারা।
ওই গ্রুপটার মতো হাসপাতালের আউটডোরের সামনের বারান্দায় পাঁচ-ছয়জন করে আরও কয়েকটা গ্রুপ। যখনই আউটডোর থেকে কোন রোগী চিকিৎসক দেখিয়ে ফিরছেন তখনই তাকে ঘিরে ধরছেন তারা। রোগীর হাত থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে মোবাইল ফোনে ছবি তুলে নিচ্ছেন। একটু পর পর হাসপাতালের আনসার সদস্যরা বারান্দা থেকে তাদের সরিয়ে দিচ্ছেন। পরক্ষণে আবার তারা রোগী দেখলেই এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলছেন। ওই হাসপাতালে সকাল দশটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত একই দৃশ্য দেখা যায়। ভিড় করে থাকা ওই লোকগুলো বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি।
হাসপাতালের আনসার সদস্য শাহনেওয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “বারবার অনুরোধ করলেও ওষুধ কোম্পানির লোকেরা কথা শুনতে চায় না। এদিকে আমাদের ওপর নির্দেশ আছে তারা যেন একটার আগে হাসপাতালে ঢুকতে না পারে। কিন্তু সকাল সাড়ে আটটা থেকেই তারা এসে ভিড় করে, রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলে। এত রোগীর চাপ সামলানোই কঠিন, তার ওপর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির বাড়তি চাপ আমাদের জন্য।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপসোনিন কোম্পানির এক মেডিকেল প্রতিনিধি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “আমরা চিকিৎসকদের আমাদের ওষুধ সম্পর্কে ব্রিফ করি। চিকিৎসকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখে তারা বুঝতে পারে চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কিনা।”
তবে কোন চিকিৎসককে ওষুধ লিখতে বাধ্য করা হয় না বলে জানান তিনি।
রোগীরা বিরক্ত তবে অভ্যস্ত
সকাল সাড়ে সাতটার ট্রেনে ঢাকায় এসে সাড়ে নয়টা থেকে লাইনে দাড়িয়ে থেকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসক দেখিয়েছেন টিউবওয়ের মিস্ত্রি আলী হোসেন (৫৫)। দুপুর সাড়ে ১২টায় যখন তিনি চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হন তখন কয়েকজন মেডিকেল প্রতিনিধি তার প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলেন। বিরক্ত আলী হোসেন বলেন, সকাল থেকে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে থাকার পর চিকিৎসক দেখলো। বের হওয়ার পর একেকজন দাড় করিয়ে ছবি তুলছে। এটা নতুন কিছু না, যেদিনই চিকিৎসকের কাছে আসি একই ঘটনা ঘটে। বিরক্ত লাগলেও বলার কিছু নেই। এটাই ওদের কাজ।
বিষয়টি নতুন নয় কাউসারের বাবা আনোয়ার মিয়ার কাছেও। তিনি জানান, কিডনির সমস্যার জন্য সাভারের এনাম মেডিকেলে চিকিৎসা করেন তিনি। সেখানেও মেডিকেল প্রতিনিধিরা তার প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলেন। নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের টাকা দেয় বলে মন্তব্য করেন আনোয়ার মিয়া।
তবে প্রেসক্রিপশন দেখতে চাইলে রোগীরা খুব বেশি বিরক্ত হয় না বলে জানান বেশ কয়েকজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। তারা বলেন, আমরা রোগীদের কাছে প্রেসক্রিপশন দেখার অনুমতি চাই। কেউ দেখাতে না চাইলে জোর করি না। রোগীরাও বিষয়টিতে অভ্যস্ত।
মিথোজীবীতামূলক সম্পর্ক
এতে শুধু যে ওষুধ কোম্পানিগুলো উপকৃত হচ্ছে সেরকম নয়।
মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা পিকনিক করলে বা চিকিৎসকেরা কনফারেন্স করলে তাদের কাছে প্রস্তাবণা পাঠানো হয়। যে কোম্পানি সেসব প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে অর্থের জোগান দেয় তাদের ওষুধ লেখেন চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশে চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানির মধ্যকার নৈতিকতার সম্পর্ক কী মাত্রায় লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে ২০১৮ সালে একটি গবেষণা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও নর্দান ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পাঁচ চিকিৎসক। ওষুধ কোম্পানিগুলো নগদ অর্থ, ভ্রমণ, ওয়ার্কশপের স্পন্সর, চেম্বার সাজানো, ওষুধের স্যাম্পল, পেশাগত বা পেশাবহির্ভূত নানা উপহার চিকিৎসকদের দিচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, “ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা যাতে রোগীদের বিরক্ত করতে না পারে সেজন্য আনসার সদস্যরা কাজ করে। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ওষুধ কোম্পানির এ অনৈতিক বিপনন ব্যবস্থা বন্ধে সবাই এগিয়ে আসতে হবে।”
মার্কেটিং পরিকল্পনা
বেশকিছু ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা কয়েকটি ভাগে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারের চেম্বারে দায়িত্ব পালন করেন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে আড়াইটা ও বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত দুই শিফটে দায়িত্ব পালন করেন তারা। তাদের তোলা প্রেসক্রিপশনের ছবি দেখে কোম্পানিগুলো ওষুধের চাহিদা নির্ধারণ করে।
সাধারণত, একটি হাসপাতালে একটি কোম্পানির দুইজন এরিয়া ম্যানেজারের তত্বাবধানে ছয় থেকে সাতজন প্রতিনিধি থাকে। তাদের ভাগে তিন থেকে চারটি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব থাকে। তারা ওই ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন। রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখে তারা বুঝতে পারে চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছে কিনা। যদি চিকিৎসক ওষুধ না লিখে তখন তাদের সঙ্গে দেখা করতে হয়। তবে কোন চিকিৎসককে ওষুধ লিখতে বাধ্য করা হয় না।
আউটডোরের তুলনায় ইনডোরে ওষুধ কোম্পানির খরচ অনেক বেশি হয় বলেও জানান অপ্সোনিন গ্রুপের এক প্রতিনিধি।
নীতিমালা থাকলেও মানা হচ্ছে না
ওষুধের বিক্রি ও প্রচারের জন্য পৃথক কোড অব ফার্মাসিউটিক্যাল মার্কেটিং প্র্যাকটিস প্রণয়ন করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ওই নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রচারের উদ্দেশে মেডিকেল পেশার সঙ্গে জড়িত কাউকে কোনো ধরনের উপহার দেয়া বা আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব কিংবা সহায়তা করা যাবে না। চিকিৎসকদের চেম্বার সাজানো থেকে শুরু করে নগদ অর্থ প্রদান করতে পারবে না ওষুধ কোম্পানিগুলো।
যদিও এ নীতিমালাও লঙ্ঘিত হচ্ছে। নিজেদের কোম্পানির ওষুধের বিক্রি বাড়াতে নানা উপঢৌকন নিয়ে চিকিৎসকের চেম্বারে হাজির হচ্ছেন বিক্রয় প্রতিনিধিরা। এসব উপঢৌকনের বিনিময়ে চিকিৎসকরাও সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওষুধ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লিখছেন।
কিন্তু বিষয়টি মানতে নারাজ ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মুক্তাদির। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিপণননীতি নিয়ে ঔষধ প্রশাসনের একটি নীতিমালা আছে। চিকিৎসকদের উপঢৌকন দেয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তা মেনে চলে বলেই আমরা জানি।”