‘আরেকবার সব হারালাম’: কক্সবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা শিবির
৪০ বছর বয়সী মরিয়ম খাতুন যখন প্রথমবারের মতো আশেপাশে ধোঁয়া আর আগুনের আঁচ টের পান, তখন তিনি ঘরে বসে দশ মাসের সন্তানকে খাওয়াচ্ছিলেন। দুই ঘর বিশিষ্ট ঝুপড়ি বাড়িটির মাত্র কয়েক মিটার দূরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে বুঝতে পেরে মরিয়ম আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে যান।
গত সোমবার (২২ মার্চ) কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আগুন লাগে। ঘটনার কথা স্মরণ করে মরিয়ম জানান, "আমি হঠাৎ করেই দেখলাম আমার ঘরের সামনে রাস্তায় মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করেছে। দরজার কাছে এসে দেখলাম, ঘর থেকে প্রায় ৩০ মিটার (১০০ ফিট) দূরে আগুনের লেলিহান শিখা। আমি কোনোকিছু ঠিকমতো ভাবতেও পারছিলাম না।"
"আমি আমার ছেলেকে তুলে অন্যদিকে দৌড়ানো শুরু করলাম," বলেন মরিয়ম। সেসময়, মরিয়মের স্বামী এবং অন্য চার সন্তান ঘরে ছিল না। আর তাই আগুন থেকে বাঁচতে তিনি কোলের শিশুকে নিয়ে একাই পালানোর চেষ্টা করেন।
সোমবার বিকালে শুরু হওয়া এই অগ্নিকাণ্ডে রাতভর জ্বলতে থাকে কয়েকটি ক্যাম্পের বাড়িঘর। তিন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হন। মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪০০ জন নিখোঁজ ছিলেন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা- ইউএনএইচসিআরের বক্তব্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ড ৪৫ হাজার মানুষকে স্থানান্তরে বাধ্য করেছে।
মরিয়ম এই ঘর ছাড়া মানুষদেরই একজন। তিনি পালালেও পিছনে তার বাঁশ আর ত্রিপলের তৈরি ঘর পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।
"হঠাৎ করেই দেখি চারদিকে কেবল আগুন আর আগুন। যেদিকেই যাচ্ছিলাম, সেদিক থেকেই আগুন আমাদের ঘিরে দাঁড়াচ্ছিল। আমি আমার স্বামী আর চার সন্তানের কথা ভাবছিলাম। ওরা বাইরে খেলছিল। আমার মনে হয়েছিল 'এই শেষ, আমরা সবাই আজ মারা যাব।'
"কিছু সময় পরে আমি নিরাপদ দূরত্বে চলে আসি। আমি জানি না, আমি আমার সন্তানকে নিয়ে কীভাবে সেখানে পৌঁছালাম। কিন্তু, তখন আমার একটাই চিন্তা ছিল, তা হল পরিবারের বাকিদের কী অবস্থা। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। তাদের খোঁজ নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না। প্রচণ্ড ধাক্কায় খৈ হারিয়ে ফেলেছিলাম। মনে হয়েছিল সবাইকে হারিয়ে ফেললাম," বলেন মরিয়ম।
পরবর্তীতে এক আত্মীয় মরিয়মকে খুঁজে পেয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।
"আমার এক ভাগ্নে ভীড়ের মধ্যে আমাকে খুঁজে পেয়ে বোনের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে স্বামীকে ফোন করি। সে সুস্থ থাকলেও, তার কাছে সন্তানদের কোনো খোঁজ ছিল না। দুঃশ্চিন্তায় মনে হয়েছিল মারা যাব।"
কয়েক ঘন্টা পর মরিয়মের বাচ্চারা তার বোনের বাসায় চলে আসে। পরিবারটি পুনরায় মিলিত হয়। কিন্তু, তখন আর তাদের বাড়িটি নেই। পরদিন মঙ্গলবার তারা বাড়িটি যেখানে ছিল সে জায়গায় যায়। ছেলেমেয়েরা সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করার মতো কিছু আছে কিনা- তা খুঁজতে লেগে যায়।
"আমরা একবার মিয়ানমারে সর্বস্ব হারিয়েছি। বাংলাদেশে এসে নতুন করে সব শুরু করেছিলাম। এখন আমি আবার সব খুইয়েছি। আমি শুধু আমার ছেলেকে নিয়েই চলে এসেছিলাম। অন্যকিছু, নেওয়ার সুযোগ পাইনি। জানিনা, এখন আমরা কী করব।"
মরিয়ম এবং তার পরিবার আত্মীয়দের কাছ থেকে বাঁশ এবং ত্রিপল নিয়ে অস্থায়ী এক আস্তানা তৈরি করেছে। তার বোন তাদের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি থেকেও তাদের কাছে কার্টুন ভর্তি খাদ্য সাহায্য এসেছে।
"আমরা সবসময় বাংলাদেশ সরকার এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর উপর নির্ভর করি। এখনও তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি," বলেন তিনি।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এবং ইউএনএইচসিআর আগুনে ঘরবাড়ি এবং সহায়-সম্পদ হারানো ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে কাজ করে যাচ্ছে।
'ঈশ্বরই জানেন যে কতজন পালাতে পারেননি'
আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে ছুটে যান ৩৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ সেলিম। আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় পালাতে থাকা লোকজন তাদের সাথে কিছুই আনতে পারেনি বলে জানান তিনি।
"সেখানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। জীবন বাঁচাতে ছুটে পালাচ্ছিল সবাই। আগুন এতো দ্রুত ছড়াতে থাকে যে মানুষ তাদের জিনিসপত্র নেওয়ারও সুযোগ পায়নি।"
"ঈশ্বর জানেন তাদের মধ্যে কতজন কোনোমতেই আগুন থেকে পালাতে পারেননি," বলেন সেলিম।
তবে, রাতে আগুন লাগলে প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ হত বলে জানান তিনি।
"ভাগ্য ভাল ছিল যে, দিনের বেলায় আগুন লাগে। সবাই খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। আগুন নেভাতে সবাই সেখানে ছুটে গিয়েছিল। অগ্নি-নির্বাপণকারীরাও দ্রুত সেখানে পৌঁছান। তাদের সহযোগিতা করতে শরণার্থী এবং স্বেচ্ছাসেবকরাও হাত লাগান। কিন্তু, বাতাস অনুকূলে না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক ঘন্টা লেগে যায়," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ কয়েকটি শরণার্থী শিবিরে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছে। অধিকাংশ, রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বড় ধরনের দমন-অভিযানের পর পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, জাতিগত নিধনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ করা হয়। তবে মিয়ানমার বরাবর এ অভিযোগ প্রত্যাখান করে আসছে।
বাংলাদেশে বর্ষাকাল আসার মাত্র কয়েক মাস আগে অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনাটি ঘটল। জুন থেকে অক্টোবর মাসে সাইক্লোন এবং ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে জনপদটিতে ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। প্রায়শ'ই তা বন্যাতেও রূপ নেয়।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান