‘টিভি চ্যানেলে ফোন করে আমাকে ভিলেন বানাতে বলেছেন বোর্ড পরিচালকরা’
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/01/04/mashrafe-040121-01.jpg)
৮ ম্যাচে মাত্র ১ উইকেট; ২০১৯ বিশ্বকাপে মাশরাফি বিন মুর্তজার এমন অনুজ্জ্বল পারফরম্যান্সে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। অনেকের মতে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ যাত্রা দীর্ঘ হয়নি অধিনায়ক মাশরাফির কারণেই। বিশ্বকাপ শেষে এ নিয়ে হা-হুতাশ আর সমালোচনার শেষ ছিল না। তবে সমালোচনার শুরুটা আরও আগেই। যেখানে প্রধান সমালোচকের ভূমিকায় ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দুজন পরিচালক।
তারা কেবল সমালোচনা করেই থামেননি, ইংল্যান্ড থেকে ফোন করে দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে মাশরাফির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করতে বলেন তারা। মাশরাফির ভাষায়, তাকে ভিলেন বানাতে বলা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর এ নিয়ে মুখ খুলেছেন বাংলাদেশের ওয়ানডের সফলতম অধিনায়ক।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় এ বিষয়টি ছাড়াও বিশ্বকাপে সাকিবকে জড়িয়ে কথা ছড়ানোর বিতর্ক, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের একটি ম্যাচে না খেলা, ওয়ানডে দল থেকে নিজের বাদ পড়া, বিসিবি ও বিসিবি পরিচালকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে কথা বলেছেন মাশরাফি। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব থাকছে আজ।
টিবিএস: টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর, বিসিবি ও বিসিবির পরিচালকদের পেশাদারিত্বসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্প্রতি আপনি কথা বলেছেন। কথাগুলো এই সময়ে কেন কিংবা কেন-ই বা বলছেন?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: কোনো না কোনো সময়ে তো কোনো কথা চলেই আসে। কারণ ছাড়াও মানুষ অনেক সময় অবস্থার ওপর কথা বলে। আমার যে বিষয়গুলো ব্যক্তিগত, যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, আমার ফিটনেস, দল ঘোষণার পর আমাকে জানানো হয়েছে, তখন খুব আমার বক্তব্যগুলো আসা স্বাভাবিক। কী জন্য? প্রথম কথা হচ্ছে, যখন আমাকে দলে নেওয়া হয়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে, তখন অনেকেই আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রথমবার দল থেকে বাদ গেছি। তখন কিন্তু আমি কথা বলিনি। তখন আমি চিন্তা করেছি যে, এটা পেশাদার সিদ্ধান্ত এবং আমি পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিয়েছি। এই শব্দটাই আমি বলেছিলাম সবাইকে।
টিবিএস: এটা গণমাধ্যমের কথা বলছেন?
মাশরাফি: হ্যাঁ, মিডিয়া। আমি শুধু বলেছিলাম, 'আই টেক ইট ভেরি প্রফেশনালি'। কিন্তু পরের ১৫-২০ দিনে একেকজন একেক স্টেটমেন্ট দিচ্ছে। মিডিয়া তো সবাইকে প্রশ্ন করবে স্বাভাবিকভাবেই। মাশরাফিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণটা কী বা এটা কী বা উনাকে জানানো হয়েছে কিনা। তো তখন উনারা সত্যি কথা বললে সমস্যা ছিল না। প্রথম কথা হচ্ছে ফিটনেস। ফিটনেসে নিয়ে যেটা বলা হয়েছে, ওই স্টেটমেন্টগুলো অবশ্যই আছে যে মাশরাফি কখনও ফিটনেস্ট টেস্টে ফেইল করেছে কিনা। আর যদি পাশ করে থাকে, তাহলে এটা বলার দরকার ছিল যে মাশরাফির ফিটনেস টেস্ট এখন আবার নাও। সেটা না নিয়ে আপনি বলছেন যে ফিটনেসে ফেইল করবে। এটা তো আমার জন্য অপমানজনক।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে, নান্নু ভাই বলেছেন, যখন টিম ঘোষণা করা হলো, উনি বলেন মাশরাফিকে জানানো হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মিথ্যা কথাটা বললেন। এরপর দেখলাম সুমন ভাই এসে একই কথা বলছেন। তখন আমার জায়গা থেকে চিন্তা করে দেখেন, আমার কী করা উচিত। আপনারা বাদ দিয়েছেন, এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নাই, কিন্তু বাদ দেওয়ার পরে যে কথাটা আপনারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন যে ২০২৩ বিশ্বকাপের কথা চিন্তা করে আমি মাশরাফিকে রাখছি না, সেটা যৌক্তিক। আমার কাছেও তাই মনে হয়। কারণ আমার তো ক্যারিয়ারের শেষের দিকে, এটা খুবই স্বাভাবিক।
এটা অপ্রত্যাশিত যে, তার সাথে উনারা এগুলা জড়িয়ে দিল যে তাকে জানানো হয়েছে, তার ফিটনেসে সমস্যা ছিল। অথচ আমার ধারণা, এখন যদি ফিটনেস টেস্ট নেওয়া হয়, যারা এলিট গ্রুপের খেলোয়াড় আছে, তাদের অনেকের থেকে বিপ টেস্ট বা ইয়ো-ইয়ো টেস্টে আমার বেশিই হবে। সেটা তো আমি জানি। তাহলে আপনি টেস্ট নিতেন, নিয়ে বলতেন। তো এসব কারণেই, আমি দেখেছি যে, মানুষের কাছে সত্যটা যাচ্ছে না, একপক্ষই শুধু বলে যাচ্ছে। এই কথা বলার আগে সুমন ভাই এবং নান্নু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি যে আমি এখন কিছু বলছি না, কিন্তু কোনোদিন মিডিয়া যদি আমাকে প্রশ্ন করে, তাহলে আমি কিন্তু সত্যিটা বলব। তখন সুমন ভাই বলেছিল, কেন তোকে কি বলা হয়নি, নান্নু ভাই বলেনি? তো আমি বলেছি, আপনারা নাকি সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, আপনি জানেন না? নান্নু ভাইকেও আমি ফোন করেছিলাম। উনি আমাকে বলেছেন, না, আমি মিডিয়ায় বলেছি, তোর সাথে আমার সৌজন্য সাক্ষাত হয়েছে। তো নান্নু ভাই কী বলেছেন সেটা আপনিও জানেন, আমিও জানি। সৌজন্য সাক্ষাতের কথা তো বলেননি, বলেছেন যে জানানো হয়েছে। তো এটা তো পুরোপুরি মিথ্যা কথা।
টিবিএস: আপনার বাদ পড়া বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা বড় ঘটনা। সেখানে তো নিশ্চয়ই নির্বাচকরা ছিলেন না, বোর্ডের অনেকে থাকতে পারেন। কোচ, টিম ম্যানেজমেন্ট কিংবা তাদের ওপরের সারির কর্মকর্তা, বোর্ড প্রেসিডেন্ট, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কিনা?
মাশরাফি: আমার কাছে মনে হয় না, কোনো জায়গা থেকেই প্রফেশনালি হয়েছে। কোনো জায়গা থেকেই মনে হয় না। কারণ, আমি কি বুঝি না আমার ক্যারিয়ারের শেষের দিক? কারণ ২০১৭ সালে যখন অবসর নিয়েছি টি-টোয়েন্টি থেকে, আমি তো বরং তখন টি-টোয়েন্টিতে ভালো বোলিং করা শুরু করেছি। তখন ২ উইকেট পেলাম প্রথম ম্যাচে। দ্বিতীয় ম্যাচে ১ উইকেট পেলাম। ইকোনমি রেট ভালো হচ্ছে। তখনই আমি অবসরে গিয়েছি। সবার কাছে পরিষ্কার চিত্র থাকা উচিত যে আমি এরকমই। যখন আমার কাছে মনে হবে যে সরে যাওয়া উচিত, সরে যাব। এই মুহূর্তে আমি কেন যাইনি, আমি বলতেও পারি খেলোয়াড় হিসেবে, কারণ আমি একটা ফরম্যাটই খেলি।
শেষ তিন সিরিজে আমি সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি, বিশ্বকাপে আমার খুব খারাপ গেছে, দায়-দায়িত্ব সব আমার ঘাড়ে নিয়েছি সবাইকে একই কথা বলেছি। কিন্তু এর মানে তো এই না, আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। আপনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মাশরাফিকে রাখব না, কিন্তু প্রশ্ন আসছে, মিডিয়া থেকেও অনেকেই বলছে, মাশরাফির অবসর স্বাভাবিকভাবে আর দশটা মানুষের মতো না হয়ে আলাদা হলে ভালো হতো, এই দায়টা মাশরাফির আছে।
এই দায় মাশরাফির যদি থাকে, তাহলে মাশরাফির কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, আমাকে কি কখনও অফিশিয়ালি বলা হয়েছে? দ্বিতীয়ত, উত্তরটা আমি দিতে পারি, পাপন ভাই আমাকে জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে ডেকেছিলেন। পাপন ভাই আমাকে ডেকেছিলেন, বলেছিলেন যে তোমার মতামত কী? তখন আমি বললাম যে, জিম্বাবুয়ের সাথে তো ওয়ানডে সিরিজ নেই, আমার জন্য নাকি একটা ম্যাচ অ্যারেঞ্জ করা হবে। তো পাপন ভাই, এটা না করে আমি বিপিএল পর্যন্ত খেলতে চাই, এরপর আমার একটা আইডিয়া হবে, আমি আপনার সাথে শেয়ার করব। তো উনিও আমাকে বললেন, তুমি বিপিএল পর্যন্ত খেলো। কারণ বিপিএল পর্যন্ত কোনো ওয়ানডেই নেই। তো আমি বলতে চেয়েছিলাম এ কারণে যে একজন খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের যে স্মৃতি, আমি সেটা নিয়ে বের হতে চাই না। এটাও কিন্তু লজিক্যাল, কারণ আমি লাস্ট তিন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়ে হঠাৎ করে একটা টুর্নামেন্ট খারাপ খেলে এভাবে মাঠ থেকে যেতে চাচ্ছি না। আমার ব্যক্তিগত চাহিদা তো থাকতেই পারে।
তৃতীয়বার একটা প্রস্তাব আসা উচিৎ ছিল, যেহেতু পাপন ভাই সম্মতি দিয়েছেন। আর আমি যদি শ্রীলংকা সফরে যেতাম, তখন তো আমি অধিনায়ক হিসেবে যেতাম। এসব কথা তো আর আসত না। এরপর করোনাভাইরাস এলো। ঢাকা লিগে এক রাউন্ড হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। এক বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এলো। তার আগেই আমি ফিট হয়ে ৫ উইকেট পেলাম। তখন তো একটা প্রস্তাবের দরকার ছিল। এক হতে পারে ওকে তো আমরা দেখিনি, তখন তো আমি চারটা ম্যাচ খেলে ফেলেছি। ভালো বোলিং করেছি। তখন যদি হতো উনারা আমাকে ডাকতো যে, আমরা ২০২৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত নতুন কাউকে ভাবছি, তুমি যেহেতু খেলবে না, আমরা তোমাকে মিনিমাম সম্মান দিতে চাই। তুমি হয় একটা ম্যাচ খেলে অবসর করতে পারো বা এই সিরিজটা খেলে করতে পারো। এই যে অফিশিয়াল প্রস্তাবটা, সেটা কি আমার কাছে এসেছিল? কেউ কি বলতে পারবে?
কেউ কি কোনো মেইল দেখাতে পারবে বা আমার কাছে কোনো এসএমএস করা হয়েছে? কেউ করে থাকলে নিশ্চয়ই তার কাছে প্রমাণ আছে। তো আমাকে বলুক সেটা। বা আমাকে ওই সময়ে ডাকা হয়েছে, এরকম একটা প্রমাণ দেখাক। বিসিবিতে গেলে তো কতো সিসি ক্যামেরা আছে, কতো কিছু আছে, একটা প্রমাণ আপনি বের করেন। আমাকে কোনো জায়গা থেকেই কোনো সময় বলা হয়নি। তো আপনি কীভাবে বলছেন মাশরাফি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে খেলে অবসর যেতে পারতো। এই প্রশ্নের জবাব তো মাশরাফি দেবে না। মাশরাফি মাশরাফির জায়গা থেকে বলবে যে আমি অবসর করব না, খেলে যাব। আপনি যখন চাচ্ছেনই মাশরাফিকে মাঠ থেকে অবসর করাতে, তখন তো আপনার থেকে প্রস্তাব আসতে হবে।
বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টিতে যেদিন ৫ উইকেট পাই, তামিম ফোন করে বলতে চেয়েছে যে ভাই, সিনারিও তো এই, আমার কিছু তো বলার নেই। দেখেন আমার কিছু করার নেই। তখন আমি তামিমকে বলেছিলাম, দেখ, আমি সব বুঝি, চাপ নিস না। তুই নতুন অধিনায়ক হয়েছিস, তুই তোর টিমকে নিয়ে ভাব। তামিম আমাকে ফোন করেছিল। সবাই যে বলছে, ভালোভাবে বিদায়টা হতে পারত, সেই ভালোভাবে বিদায় কখনও একপক্ষ দিয়ে হয় না। সেটার জন্য কাউকে না কাউকে ম্যানেজমেন্ট থেকে এগিয়ে আসতে হয়, শুধু মুখে বললেই হয় না। ওই খেলোয়াড় দেশের জন্য অনেক কিছু করেছে। আপনার আচরণ বলবে যে আপনি আসলে সম্মান করছেন নাকি করছেন না। এটা খালি মুখে বলে মানুষকে শোনানোর বা দেখানোর ব্যাপার নয়।
টিবিএস: বোর্ড বা বোর্ড সংশ্লিষ্ট মানুষদের নিয়ে এই ধরনের কথা বলে জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। আপনি কি ধরেই নিয়েছেন যে জাতীয় দলে আর খেলা হচ্ছে না?
মাশরাফি: আমার বয়স এখন ৩৮। আমার সুযোগ খুবই কম। আমি তো ক্রিকেটটা খেলতে চাই। আমি তো বলেছি, কী খেলতে চাই। ডমেস্টিক খেলছি। সেটা আগেও বলেছি, এখনও বলছি। সেটা আমি যখন বাদ পড়েছি, ধরে নিয়েছি, আমার সুযোগ খুব কম। এটা খুবই স্বাভাবিক। বয়স ৩৮ চলে, মুখ দিয়ে বললেও তো কেমন শোনা যায়। এখন আমি কোনো কিছুই ধরে নিচ্ছি না। কাল কী হবে কেউ জানে না। আমি খেলাটাকে পছন্দ করি, খেলাটার মাঝে আনন্দ পাই, এখন আমার হাজার কাজ আছে। বাংলাদেশ দলে তো ২০ বছর খেলেছি। তো খেলার জন্য খেলা না। খেলাটাকে আমি পছন্দ করেছি। জীবনের শুরু থেকেই ভেবেছি যে এই খেলাটাই আমি খেলব। অনেক সুযোগ সুবিধা আসা সত্ত্বেও আমি নিইনি কেন, আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলেই আনন্দ পাই। এসব কারণে আমি এই খেলাটাকে নিয়মিত করতে চেয়েছি, যতদিন পারি খেলব।
এখন ডমেস্টিক ক্রিকেট খেলতে গেলে তো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কিছু নেই এখানে, এই কারণে আমি খেলতে চেয়েছি। কোড অফ কন্ডাক্টের বিষয় না থাকলে ২০১৭ সালেই কথাটা বলতাম, আমার কীভাবে হয়েছে। আমি বরং চোখে আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখিয়েছি, পেশাদারিত্ব কী জিনিস। ২০১৭ সালে মিডিয়া আমার পক্ষে ছিল। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা মানুষ আমার পক্ষে কথা বলেছে- যে কেন অবসরে গেল। একমাত্র আমিই মুখ খুলিনি। আমি চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়, কথা বলতে গেলে, আমাকে এমন একটা পর্যায়ে বলতে হবে, যেন ক্রিকেট বোর্ডের সাথে আমার দন্দ্ব না হয়। অবশ্যই ক্রিকেট বোর্ডেরও দায়িত্ব ছিল ব্যাপারগুলো ঠিকভাবে বলার, তারা কিন্তু করেনি। এখানে পেশাদারিত্ব কেউ দেখাতে পারিনি। আমার কথা যদি বলেন, সেটা আপনাদের বিবেচনার বিষয়, পেরেছি কি পারিনি। বিবেচনা করে দেখেন যে, আমি কোথাও বিতর্কিত কথা বলেছি কিনা আমার পুরো ক্যারিয়ারে, বিসিবির বিপক্ষে।
টিবিএস: টি-টোয়েন্টি অবসর নিয়ে আপনি বলেছেন বাধ্য হওয়ার কথা। মাশরাফি কীভাবে বাধ্য হলেন?
মাশরাফি: আগে টেস্ট সিরিজ ছিল বোধহয়। ১০০তম টেস্ট জিতলাম। ওয়ানডে টিমে তো ৪-৫টা খেলোয়াড় যাবে। আমাদের ওয়ানোডে টিমেরও মিটিং হাথুরুসিংহে করে ফেলেন। নিউজিল্যান্ড সিরিজে আমার এই আঙুল ভেঙে যায়। আমি ফিজিও দিয়ে চেক-আপ করে, আমার বোলিং দেখে সিদ্ধান্ত নিই যে ঠিক আছে। তারপর মিটিং হয়, আমার সাথে বসে পুরো টিম নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর আমি যখন শ্রীলঙ্কায় যাই, আমি শ্রীলঙ্কায় পা রাখার পরে, হোটেলের লবিতে, টিম টেস্ট খেলে আসবে, টেস্টের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন। টিম আসবে, এ কারণে আমি আর রুমে যানি। চাবি নিয়ে নিচে বসে আছি। যখন টিম আসছে, সবার সাথে হাই-হ্যালো করে রুমে যাব। তখনই আমার সাথে যখন একটা মিটিং হয়, আমি খুবই অবাক হই। ওইদিন টেস্ট চলছে, আমি মাত্র এসেছি, আমাকে তখন যেসব কথা বলা হয়, আমি না তখন ধরতে পারিনি, হঠাৎ করে এ রকম কেন কথা বলা হচ্ছে। আপনি চাইলে তো হাজারটা ভুল তামিমেরও ধরতে পারবেন। তাই না? কিন্তু সত্যিকার অর্থে, আপনি যদি সেটাকে বক্তিগতভাবে নেন। আমি যেটা দেখছি, আমার সাথে যেটা কথা বলা হচ্ছে, স্রেফ ব্যক্তিগত আক্রমণ ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমি ধৈর্য্য ধরে আছি যে, ঠিক আছে, আমার একটু বোঝা দরকার।
টিবিএস: কারা কারা ছিল মিটিংয়ে?
মাশরাফি: ওখানে সুজন ভাই ছিলেন আর হাথুরুসিংহে ছিলেন। সুজন ভাই কোনো কথা বলেননি। হাথুরুসিংহে বলছিলেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তখন আমি ভাবি হাথুরুসিংহে বলছে, কোচ হিসেবে বলতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে বলার কারণটা কী? তখন আমি রুমে গিয়ে ভাবি বিষয়টা নিয়ে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকেও রাখতে চায়নি, আমি সভাপতির সাথে কথা বলে ম্যানেজ করি। ওই রাগটাও থাকতে পারে। আমার কাছে সেটা মনে হয়েছিল ওই সময়ে। আমি যেহেতু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হয়ে স্ট্যান্ড নিয়েছি, তো স্বাভাবিকভাবেই ওর সাথে আলোচনা করিনি কেন, একটা রাগ থাকতে পারে। তো আমাকে ওই সময় ধৈর্য্য ধরতেই হতো বিষয়টা কী বোঝার জন্য।
সবকিছুর পরে প্র্যাকটিস ম্যাচ গেল, আমার মনে হচ্ছিল না যে দল এভাবে চলছে। প্রথম ম্যাচে যখন জিতলাম, আমি ২ উইকেট পেলাম। এসে দেখলাম যে সবকিছু স্বাভাবিক হলো। দ্বিতীয় ম্যাচ গেল। আমার ভেতরে প্রতিক্রিয়া চলছে তখন যে, এখানে কী চলছে। তুতীয় ওয়ানডেতে ওদেরকে ২৮২ না ৮০ রানে আটকে দিয়ে জিততে পারলাম না। আমি ৩ উইকেট পেলাম। ওইদিন প্রথম আমার সাথে কথা হয়, যে এই ব্যাপার, এখন তোমার কী সিদ্ধান্ত, তুমি খেলতে চাইলে খেলো। আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, আমি তো আকাশের থেকে পড়ছি।
টিবিএস: এটা বোর্ড কর্তারা বলছিলেন?
মাশরাফি: হ্যাঁ। তো আমি তারপরে বললাম যে, জোর করে তো খেলা সম্ভব না। তারপর আমি তামিমের সাথে কথা বলেছি, রিয়াদও ছিল, বেশ কয়েকদিন ধরেই চলেছে। তারপর তামিম আমাকে বললো যে ভাই আমার মনে হয় না আপনাকে খেলতে দেবে, ভালো হয় আপনি সম্মান থাকতে থাকতে সিদ্ধান্ত নেন। তো এগুলা আমাকে সাহায্য করেছে অনেক ওই সময় সিদ্ধান্ত নিতে। বেশ কয়েকদিন ধরেই চলছিল, ফ্যামিলিতেও কথা বলেছি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের আগের রাত্রে। সম্ভবত দুই তলায় আমরা নিজেরা একটা পিকনিক করি, ইমরুল খিচুড়ি রান্না করে। ওইদিন আমি সিদ্ধান্ত নিই। যদিও ঘোষণা দেইনি তখনও। আমি ফোন করেছিলাম আমার স্ত্রী, মা-বাবা, মামা ও পিচ কিউইরেটর বাবু ভাইকে। আরও দুই-একজন আছে। এদেরকে আমি ফোন করে জানিয়ে দিই। টিমকে জানাই টিম মিটিং এর আগে। আর পাপন ভাইকে জানাই প্রথম ম্যাচের আগে। অন্য সবাইকে জানাই দ্বিতীয় ম্যাচের আগে। পাপন ভাইকে জানালে উনি বলেন, ঠিকাছে। তখন আমি আরও পরিষ্কার হই, উনারা তাহলে এটাই চাচ্ছে। যেহেতু কোচ ওই সময় চাচ্ছে।
টিবিএস: তার মানে আপনার সিদ্ধান্তে কেউ-ই অবাক হননি?
মাশরাফি: না! যিনি অধিনায়কত্ব দিয়েছিলেন, তাকেই তো আমি জানাবো সবার আগে। অন্য কাউকে না। ফ্যামিলির আগে উনাকে জানাবো। তো আমার যেটা মনে হয়েছিল, কোচ যেটা বুঝিয়েছে উনারা সেটা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। আমার কাছে প্রথম টি-টোয়েন্টির পর মনে হয়েছে, আপনি যুদ্ধ করতে পারেন কার সাথে। আপনি একজন খেলোয়াড় হিসেবে আপনার অফ-ফর্মের সাথে যুদ্ধ করতে পারেন। আপনি ফর্মে নেই, আরও মনোযোগী হয়ে কীভাবে ফর্মে আসতে পারেন কোচদের সাহায্য নিয়ে, সেটা ভাবতে পারেন। আপনি যুদ্ধ করতে পারেন আপনার বিপক্ষ দলের সাথে। যে কোচ আছে, তার সঙ্গেও পারেন। আমিতো আমার দেশের জন্য খেলি। আপনি ক্রিকেট বোর্ডের মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারেন না। উনারা তো আমারই মানুষ। যেমন ওখানে ছিলেন বোর্ড কর্মকর্তারা, সুজন ভাই, ম্যানেজার যে বা যারা ছিল। এদের সাথে কী আমি যুদ্ধ করতে পারি?
টিবিএস: আপনার ওয়ানডে অবসর নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিশ্বকাপে লর্ডসে অবসর নিয়ে নিলে ভালো হতো কিনা।
মাশরাফি: নিলে ভালো হতো কী না তা ভাবিনি। তবে ওই সময় আমি আউট অব মাই মাইন্ড ছিলাম। এটা যে কোনো খেলোয়াড়ই হতো। প্রথম দুই ম্যাচে তো আমি স্বাভাবিক ছিলাম। দুই ম্যাচে উইকেট পাইনি এমন ঘটনা কি নেই? দর্শকরা বিশ্বকাপের মতো জায়গায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। মিডিয়া থেকেও কথা উঠবে। দেখলাম আমার চারপাশের মানুষজন পাজলড হয়ে যাচ্ছে, ক্রিকেট বোর্ডের লোকজন, কারো না কারো বাসায় গিয়ে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। আমাকে নিয়েই শুধু কথা। টিম কিন্তু দুই ম্যাচের একটা জিতেছে এবং আমরা ভালো জায়গায় আছি। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে নিয়েই শুধু প্রশ্ন হচ্ছে। তখন সময়ের সাথে সাথে মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকি। একজন পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে বললে এসব কানে নেওয়া উচিত না। আমি সেসব না ধরলেও ফিরে আসতে পারিনি। হয়তো বা আমি আমার পেশাদারিত্বের ভেতর থাকতে পারিনি। আমি ওটার ভেতর ঢুকে গিয়েছিলাম।
এমনকি পাকিস্তানের ম্যাচের আগে অনুশীলন করতে গিয়ে ভেবেছি, এখান থেকে আমি কবে দৌড়ে চলে আসব। মানে এরকম একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। আমি তখন ড্রেসিং রুমে বসে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিই আমি খেলব না। সাকিবকে গিয়ে বলি, আমি খেলতে চাই না। সাকিব বলে, কেন? আমি বললাম, আমাদের তো সুযোগ নেই। তা ছাড়া মনে হচ্ছে না আমার দ্বারা কিছু হবে। তখন সাকিব আর কথা বলেনি। আমি কোচকে বলি, কোচ একবারেই বলে এটা তোমার ব্যাপার। এরপর আমি অনুশীলনেও নামিনি, প্রেস কনফারেন্সেও যাইনি।
যখন আমি রুমে আসি, তখন আমার কাছের মানুষজন আমাকে বলে, আপনি যা করার করে ফেলছেন। যা হবার হয়ে গেছে। আপনি যদি এখান থেকে ফিরে আসেন, সেটা কত বড় ভুল হবে বা দুর্বল মানসিকতার পরিচয় দেওয়া হবে, সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না। একটা জিনিস হচ্ছে পারফরম্যান্স খারাপ করতে পারেন, সেটা হয়েছে। কিন্তু এখান থেকে ফেরাটা আপনি কতটা দুর্বল, সেটা বোঝায়। তখন আমি আবার সাকিবকে বলি, তিন থেকে চারবার বলি। তখন সাকিব বলে আমি যা করার করে ফেলেছি। আমি মানসিকভাবে এতো ভালো অবস্থায় আছি, আপনি সকাল পর্যন্তও সময় নিতে পারেন।
আমার কনসার্ন ছিল, সাকিব বিরক্ত হবে কী না। সাকিবের ব্যক্তিত্বে কোনো আঘাত আসবে কী না। আমি ওকেবলি তুই আর দশ জনের মতো না। তোর যদি কোনো জায়গা থেকে ইগোয় টাচ করে, যেহেতু মিটিংয়ে বলা হয়েছে। এখন তোর ইগোয় লাগলে আমি খেলব না। ও বলে, দেখেন ভাই আপনার আমার সম্পর্ক এমন? আপনি কালকের ম্যাচ খেলেন কোনো সমস্যা নেই। আর যদি নাও খেলেন, সকালে সিদ্ধান্ত দেন তাও কোনো সমস্যা নেই। এবার বাকি থাকল কোচ। ওর সাথে আমার আধাঘণ্টা কথা হয়। ও বারবার কারণ জানতে চায়। তার কথা ইমশোনাল সিদ্ধান্ত আমার। ও বলে, খেলো। তারপর তো পাপন ভাইরা মিটিংয়ে আসে। উনাদের সাথে কথা বলি। তো সকালে উনারা জানে হয়তো মাশরাফি খেলবে না। তখন আমি বললাম, পাপন ভাই আমি খেলছি। সবাই জানে আমি খেলছি। তো এটা ছিল এইখানে বিষয়।
তখনই আমি ওই কথাটা বলি, আপনারা যদি চান এই ম্যাচ খেলেই আমি অবসর নিয়ে নেব। আসলে আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আগে তো অন্তত আমার ফ্যামিলিকে জানাতে হবে। আমি তারপরও ওটা বলে ফেলি। আমার মানসিক অবস্থা এতটা খারাপ ছিল। আমি বলি আমার আর বেশিদুর আমার আগানোর দরকার নাই। উনারা বলেন দরকার নেই। তুমি দেশে গিয়ে ভালোভাবে সুন্দরভাবে অবসরে যাও। সেখানে বোর্ড প্রধান থেকে শুরু করে সবাই ছিল। যদিও সবার সামনে বলেনি, সাইডে গিয়ে সুজন ভাইসহ কথাটা হয়।
অধিনায়ক হওয়ার পর থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক ভুল সিদ্ধান্ত আছে। ম্যাচের ভেতর বা কোনো খেলোয়াড়কে পিক করার ভুল সিদ্ধান্ত আছে। কিন্তু ব্যাক্তি জীবন বা অধিনায়কত্ব নিয়ে যদি ভুল সিদ্ধান্ত বলেন, সেটা ওই দিন সকালে আমি বলা, না খেলা এবং সন্ধ্যার সময় সাকিবকে বলা খেলব। এই সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা, আমি সেটাকে বলব, আমি দুর্বল মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলাম সেদিন। এটাই ছিল ঘটনা। যে বলছিল, হুট করে মাঠে মাশরাফিকে দেখলাম, এটা পুরোপুরি মিথ্যা কথা এবং এরকম কিছু না। এটা পুরা একটা প্রসেসের ভেতর দিয়ে যাওয়া হয়েছে।
টিবিএস: বিশ্বকাপে আপনার বাজে ফর্মের সময় একটি টিভি চ্যানেলে ফোন করিয়ে আপনার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করানোর একটা ঘটনা ঘটেছিল। কতুটুক জানেন আর এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মাশরাফি: আমার যতো খারাপ লেগেছে, আমি কোনোদিন ক্রিকেট খেলে যদো কষ্ট পেয়েছি, এই একটা জিনিসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি । তখন আমি বুঝতে পেরেছি অন্যান্য খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে কতো কী না হয়েছে, কতো কী না হতে পারে বা হয়। আমি এটা কোনোদিন বিশ্বাস করিনি, করতে চাইওনি। এ রকম হয় নাকি ধুর্!
কিন্তু মিডিয়ায় ফোন করেছে উনারা। ইংল্যান্ডে বসে আমাদের বোর্ড ডিরেক্টরের দুই জনের তথ্য আমি জানি যে, কোনো কোনো চ্যানেলে উনারা ফোন দিয়ে বলেছেন, আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে মাশরাফিকে নিয়ে নিউজ করে দেন, মানুষের সামনে মাশরাফিকে কালার করে দেন। ভিলেন বানিয়ে দেন। খারাপ খেলার কারণে ভিলেন তো এমনিই হয়ে আছি। তারপরে আপনি চিন্তা করেন, ক্রিকেট বোর্ড তো আমার পাশে দাঁড়াবে। পাশে দাঁড়িয়ে তো আমাকে সুন্দরভাবে বাদ দেয়া যেত। ছেলেটা তো কিছু না কিছু করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য। খেলেছে তো অন্তত। অন্তত আমার পাশে তো দাঁড়াবে। কারণ দর্শকরা তো অনেক কিছু বুঝবে না বা মিডিয়াও অনেক কিছু নাও বুঝতে পারে যে ভেতরে কতো ইতিহাস, কতো গল্প আছে। এগুলা তো বোর্ডের সবাই জানে।
তখন উনারা যা করল। আমি উনাদের নাম বলব না, আমি দুইজনের নাম জানি। আল্লাহই জানে আরও মানুষ আছে কী না। মিডিয়াকে ফোন করে করে বলছে, সুযোগ আসছে, মাশরাফিকে নিয়ে বাজে নিউজ করে দেন। বাদ দিয়ে দেই। তারা আবার আমার প্রতি এতটা সদয় ছিল, আমার প্রতি এতোটা অন্যায় করতে চায়নি, তারা আবার আমাদের কাউকে না কাউকে জানিয়েছিল। আমরা এ নিয়ে আবার আলোচনা করেছি। তারা ভিতু হয়ে গিয়েছিল যে এরকম হইতে পারে! তারা আবার আমাকে বলেনি। তারা আবার আমাকে দুই তিন দিন পরে বলেছিল। তাদের ভাবনা মাশরাফির সাথে যদি এটা হতে পারে, তাহলে আমাদের সাথে কী হবে।
এটা তো সত্যি, আমার বিশ্বাস ওই মিডিয়াই কোনো না কোনো দিন ওদের কথা বলবে। কারণ আমি বিশ্বাস করি সত্য এমন একটা জিনিস যা কখনও আটকিয়ে রাখা যায় না। উপরে আল্লাহ আছেন, বিচার করেন। বিচার ইতোমধ্যে কিন্তু একজনের হয়ে গিয়েছে। দুর্নীতির দায়ে একজনের অনেক কিছু হয়ে গেছে। বাদ দেয়ার ক্ষমতা আছে কিন্তু সম্মানহানী করার ক্ষমতা আপনাকে কেউ দেয়নি। দেখেন উনার কিন্তু সম্মান সব গেছে। মাশরাফি তো কিছু করেনি। তো এরকমই হবে। এটা হয়তো পাপন ভাই জানেও না যে, উনারা এসব কাহিনী করেছে।
টিবিএস: সংবাদমাধ্যমকে ভায়া করে বোর্ড ও ক্রিকেটারদের কথা বলার একটা প্রবণতা আছে। অধিনায়ক হিসেবে আপনার শেষ সিরিজের আগে বিসিবি সভাপতি ঘোষণা দিয়ে দেন। সর্বশেষ বিসিবিকে নিয়ে সাকিব আল হাসানের সমালোচনা করার পরও এমন হয়েছে। এটা কতোটা বাজে সংস্কৃতি?
মাশরাফি: ভালো তো, আপনাদের জন্য সুবিধা। আপনাদের তথ্য পেতে সুবিধা। না, এটা তো একটা এজেন্সির মতো হয়ে যাচ্ছে। মিডিয়ার সাথে যখন একটা খেরোয়াড় দেখে থাকি যেমন, আমাদের কাছে যখন একটা কোম্পানি আসে, তখন আমরা ব্যস্ত থাকলে আমাদের এজেন্টরা কথা বলে। তো আপনারাও এজেন্টের মতো কাজ করছেন। বিসিবির এজেন্ট হিসেবে মিডিয়া আছে। এটা তো পেশাদারিত্বের সবচেয়ে নিচু স্তর। সবখানে প্রতেকটা কথা মিডিয়াতে আগে।
আপনারা সাংবাদিকতা করেন, যখন বাংলাদেশের খেলা নেই তখন বাইরেরটা লিখতে হয়। আপনারা নিশ্চয় খোজ খবর, আপনাদের কাছে সব তথ্য থাকে। বহিঃবিশ্বে অন্যান্য টিমগুলা যখন ঘোষণা হয়, দল ঘোষণার সময় অনেক কিছু ধারণা করেন। কিছু কমন খেলোয়াড়ের সাথে নতুন কিছু নিলে আপনার চিন্তার সাথে মিলবে না। ওদের মিডিয়ায়ও দেখবেন, তাদেরও একজন দুইজন মিলবে না।
কিন্তু একমাত্র মিডিয়া বাংলাদেশের, কোনো সিরিজের আগে যদি ১৫ জনের দল লিখে দেন, দল ঘোষণার সময় ৯৫ ভাগই মিলে যায়। ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে আপনারা যে তথ্য দেন, সেটাই সত্য হিসেবে বের হয়। তার মানে কী, নিশ্চয় স্পাই হিসেবে কেউ আছে। এটাও তো আইন বহির্ভুত একটা কাজ। এটা কী পেশাদারিত্ব! তো আমি যেটা বলতে চাই, পুরো মিডিয়াকে ভায়া করে সব জায়গায় মেসেজ দেয়া, আমার মনে হয় না উনারা ইচ্ছা করে এটা করে। এটা উনাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
টিবিএস: বোর্ড পরিচালক, দর্শক, সাংবাদিকদের অনেকেরই অভিযোগ, আপনিও দলের অনেক খবর বাইরে দিয়েছেন…
মাশরাফি: কোনটা বলেন? সাইফউদ্দিন ও রিয়াদের দুটি ঘটনা, আমি দুটিই বলছি। ব্যাক ইনজুরির কারণে সাইফউদ্দিন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ খেলল না। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমি যখন ঘোষণা দিই যে অধিনায়ক হিসেবে আমি শেষ ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি, ওইদিন প্রথম এসে সাইফউদ্দিন আমাকে বলেছে যে, ভাই আমার ওই নিউজটা যে হয়েছিল, আপনিই বলেছিলেন। আমি বলেছি তোর কি বিশ্বাস হয়? ও তখন বলে আমাকে দলের সিনিয়র এক ভাই বলেছেন, বোর্ড থেকে বলেছে এবং সাংবাদিকরাও কয়েকজন বলেছেন। তো তখন আমি ওকে প্রমাণ করি, যে নিউজটা করেছেন, আমার বলা ঠিক না তাও আমি উনাকে অনুরোধ করি, যে আপনি সত্যি কথাটা বলেন। আমি ওকে ফোন দিয়ে শুনিয়ে দিই। বলি যে ভাই আমি ক্রিকেট ছেড়েই দিচ্ছি, আজ সত্যি কথাটা বলেন। একটা বাচ্চা ছেলে, যে ক্রিকেট শুরু করেছে মাত্র, সে ছয় থেকে আট মাস আমাকে নিয়ে একটা ভুল ধারণায় আছে। আমি চাই না আমি যাওয়ার সময় ছেলেটা ভুল ধারণা নিয়ে থাকুক।
উনি বলেছেন আমাদের একজন সিনিয়র বলেছেন। আমি নির্বাচকের নাম বললাম না। আমাদের একজন নির্বাচক ওই সাংবাদিককে বলেছেন। তখন সাইফউদ্দিন আমাকে বলে দেখেন ভাই আমাদের সিনিয়র একজন খেলোয়াড়ও আমাকে এটা বলেছে আপনি বলেছেন। তামিমের একটা নিউজ একদিন পত্রিকায় আসে। ওই রিপোর্টারকে ফোন করে আমি স্পিকারে দিই, যেহেতু আমি অধিনায়ক, ঘুরেফিরে দায় আমার ওপরও আসে। এই কারণে আমি বারবার বলি বিসিবিতে কনফিডেনিশিয়াল আলোচনা যখন হয়, অধিনায়কও থাকে, যেহেতু আমার কথা খেলোয়াড়রা ভাবে। কিন্তু ওইখানে যে আরও মানুষ থাকে, তারাও যে লিক করতে পারে, এ চিন্তা করার আগে খেলোয়াড়রা ভাবে নিজেদের মধ্যেও কেউ আছে কিনা।
এরপর রিয়াদ ও সাকিবের যে বিষয়টা, ড্রেসিং রুমে সাকিব যে কথাটা বলেছিল যে ভাই আমাদের ৬০ বলে ১২৩ রান লাগবে। তখন রিয়াদ গিয়ে একটু সেট হতে চাচ্ছে, তখন সাকিব বলছে ভাই এভাবে ব্যাটিং করলে কেমন হয়। জেতার জন্য খেলতে হবে তো। যতই রান থাকুক, আমাদের ওটাকে তাড়া করতে হবে। এভাবে খেললে হবে না। ঠিক এই কথাটা আমি মিটিংয়ে এসে বলেছি এবং হ্যাঁ আপনাদের কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম, তখনও বলেছি। সাকিব এটা নিয়ে একটু রেগেছে। পরের দিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ ছিল, দলের অনুশীলনের সময় একটা পাশে রিয়াদের সাথে আমি দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ কথা বলছিলাম। রিয়াদকে আমি সব খুলে বলেছিলাম। বলেছিলাম এই অবস্থা, তুই এভাবে করিস।
রিয়াদ সব জানে, তাহলে এই বক্তব্য আসার পরে রিয়াদ নিশ্চয়ই একটা রিঅ্যাকশন দিতো, রিয়াদ সত্যটা জানে যে কী হয়েছিল। সাকিবও একটা রিঅ্যাকশন দিতো, সাকিবও জানে ও কী বলেছে। আর আমি মিডিয়ার কয়েকজনের সামনেই বলেছিলাম। আমার বলা সবগুলো কথা আসেনি। আমিই একমাত্র যে বলেছিলাম, বিশ্বকাপে যদি সাকিব অধিনায়ক থাকতো, এই দলটা সেমি ফাইনালে খেলতো। এটা আমি বিশ্বাস কর বলেই বলেছিলাম। কয়েকজন মিডিয়ার মানুষ ছিল ওখানে। প্রথমবার যখন বলি সুজন ভাই, সাব্বির ভাই এবং ম্যাসেসম্যান বুলবুল এই তিনজন ছিল, আমরা দেশে আসছিলাম, এয়ারপোর্ট বসে আমি বলেছিলাম। দেশে নেমে কয়েকজন সাংবাদিকের সামনে বলেছিলাম। সাকিবকে নিয়ে ভালো কথা যে বললাম সেটা কিন্তু লেখলো না, যে সাকিব অধিনায়ক থাকলে বাংলাদেশ সেমি ফাইনাল খেলতো। কারণ সাকিব যেভাবে পারফর্ম করেছে, দলের সামনে একটা উদাহরণ থাকতো। যেটা আমি তৈরি করতে পারিনি। অনেক খেলোয়াড়ই আমাকে অনেক সময় ভুল বুঝেছে।
সাকিব কিছুদিন আগে বক্তব্য দিয়েছে টিমের কথা বাইরে আসে কীভাবে। এখন তো মাশরাফি নেই, তো আসছে কীভাবে। আমি এইদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। এরপর আরও বহু কথা আসবে। এই কারণে আমি বলছি, কেউ একজন আছে স্পাই হিসেবে করে। একজন না, এখানে কয়েকজন আছে। স্বার্থ উদ্ধারের বিষয় না, তারা তেলবাজি করে মানুষকে খুশি করার জন্য, কাউকে খুশি করে বোর্ডে একটা জায়গায় ঢোকার জন্য বা কারও কারও অভ্যাসগত কারণে করে। অভ্যাসে পরিণত হওয়ার কারণে দেখা গেছে অনেকে বউ বাচ্চার সামনেও মিথ্যা কথা বলে। এটা তো রোগ। আমার মনেহয় এমন লোক বসে আছে। তেলবাজি বা এসব করাই তাদের কাজ।
টিবিএস: বোর্ড পরিচালকদের বাইরে গিয়ে খেলা দেখা বা সামনে আসা, ২০ বছরে আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে? অন্যান্য দেশে কেমন?
মাশরাফি: আমি ২০ বছর ক্রিকেট খেলেছি, কিন্তু কোন দেশের বোর্ডে কে আছে আমি জানিও না। বিদেশে গেলে সেই দেশের বোর্ডের পরিচালকরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসে, সেই হিসেবে জানার কথা। তারা সেটাও আসে না। আমরা ক্রিকেট খেলেই জানি না। আপনারা সাংবাদিকতার কারণে জানতে পারেন। আমার ধারণা বাংলাদেশের সবারটাই বাইরের মানুষ জানে। আমার ধারণা পাপুয়া নিউগিনির ওরাও জানে বাংলাদেশ বোর্ড পরিচালক কে।
টিবিএস: বোর্ড পরিচালকরা বিভিন্ন সময়ে বড় টুর্নামেন্টে দলের সঙ্গে যান। এতে দলের লাভ-ক্ষতিটা কী?
মাশরাফি: লাভের চিন্তা খেলোয়াড়রা করে না, লসের চিন্তাও করে না। লাভের লাভ হয় মাঝে মধ্যে আমাদের দুই-একটা ডিনার করায়। এটা একটা লাভ হয়। এর বাইরে খেলোয়াড়দের লাভ-লস নেই। খেলোয়াড়রা ভালো করেই জানে উনাকে দিয়ে আমার ক্রিকেট খেলা হবে না। আমাকে আমার পারফর্ম করতে হবে। তবে এতুটুকু জানে পারফর্ম যদি না করতে পারে, এরা কী করতে পারে। উল্টো ভয়ের কিছু জায়গা থেকে যায়। তামিমের ক্ষেত্রে ২০১৫ বিশ্বকাপে একই হয়েছে। তামিম পুরো রাত ধরে কান্নাকাটি করেছে। এটা ওপেন সিক্রেট, অনেকেই জানে। আমি আজ বলছি। স্কটল্যান্ড ম্যাচের একদিন আগে তামিম সারা রাত ধরে কেঁদেছে। এমন ঘটনাই বরং আছে।
পাশে দাঁড়ানো আর না দাঁড়ানো এক নয়। উনারা যে কথা বলেন, মনে হয় আমাদের পরিচিত কেউ নেই। বা আমাদের কাছে এই কথাগুলো আসে না। আপনি এই কথা বলতে পারলে সামনেই বলেন। সমাজে না ছড়িয়ে সামনেই বলেন। আর এসব সমালোচনা তো আপনি করতেই পারেন না। কারণ আপনাকে এটা ভাবতে হবে যে এই খেলোয়াড়ের জন্যই আমরা ওখানে বসে আছি। এটাই বাস্তবতা। ক্রিকেটাররা খেলার কারণেই আপনার মূল্যায়ন হচ্ছে এবং এখানে আপনি আজ বসে আছেন তাদের কারণেই। তাদের ফ্যাসিলিটিস দেওয়ার দায়িত্ব আপনার, আপনাকে সম্মান করলো কিনা এটা দেখার দায়িত্ব আপনার না। তারপরও আমাদের খেলোয়াড়দের কখনও দেখিনি যে বোর্ড পরিচালক তো অনেক উপরে, বিসিবিতে চাকরি করা কারও সাথেও খারাপ ব্যবহার করতে। কিন্তু দেখে আসছি খেলোয়াড়রাই সব সময় কথা শোনে। আমি এখন দলে নেই একতরফাভাবে বলতে পারি, সিনিয়রদের নিয়েও বলতে পারি। কিন্তু বলতে পারছি না কারণ আমি সত্য দেখে এসেছি। আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি যে ঘটনা কী। আমাকে দলে নেওয়া হয়নি বলে বা আন্দোলনে আমাকে নেওয়া হয়নি বলে আমি ওদের বিরুদ্ধে কথা বলব, তা না। যেটা সত্য আমি সেটা বলার চেষ্টা করছি।
টিবিএস: তার মানে পারফরম্যান্সের কারণে বোর্ড থেকে জনসম্মুখে ক্রিকেটারদের যেভাবে সমালোচনা করা হয়, সেটা বাজে দৃষ্টান্ত?
মাশরাফি: পারফরম্যান্সের কারণে সমালোচনা হওয়া কখনও বাজে দৃষ্টান্ত নয়, সেটা যদি দর্শকরা করে। দর্শকরা সমালোচনা করার পরে যদি কোনো খেলোয়াড় অভিযোগ দেয়, আমি বলব ওই খেলোয়াড়ের খেলাই ঠিক না। সংবাদমাধ্যমের লেখা দেখে যদি কোনো খেলোয়াড় বিচলিত হয়ে যায়, তাহলে আমি বলব ওই খেলোয়াড়ের না খেলে ঘরে বসে থাকা উচিত। এই দুটি পক্ষের কাজই সমালোচনা করা। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ড যখন ঢালাওভাবে সমালোচনা করবে তখন আমি অবশ্যই খেলোয়াড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো।
কারণ আমরা দেখেছি শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে লেখা হয়েছে এন্ডুলকার। একট সময়ে এসে টেন্ডুলকারকে বলা হয়েছে এন্ডুলকার। মিডিয়া এটা লিখেছিল সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়কে নিয়ে। তো তাকে নিয়ে যখন লেখা হচ্ছে ভারতের সর্বোচ্চ পত্রিকায়, কই শচিন কি এসে মিডিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে? না, ঠান্ডা মাথায় ছিল। সবচেয়ে বড় বিষয় বোর্ড শচিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাকে নিয়ে মিটিং হয়েছে যে সে ফর্মে নেই, কী করা যায়। কিন্তু ওই মিটিংয়ের খবর কী মিডিয়ার কাছে ছিল? ছিল না। এটাই পেশাদারিত্ব। শচিনের জন্য যতটুকু করা দরকার ছিল ততোটুকু তারা করেছে। হয়তো শচিনের সাথে ১০ বার কথা বলেছে কিন্তু আমরা কেউ জানি না। ভারতের মিডিয়া বা দর্শকদের কেউ বলতে পারবে না। শচিন গ্রেটেস্ট খেলোয়াড় এমনি, তারপরও সে ফর্মে ফিরেছে, ওর পরে এসে এক সিজনে ৭-৮টা সেঞ্চুরি করেছে। তো এটাই উদাহরণ।
একজন খেলোয়াড় যখন পারফর্ম করে না, তখন কাউকে না কাউকে পাশে দাঁড়াতে হয়। শুধু সতীর্থ বা পরিবার পাশে দাঁড়ালে হয় না। বোর্ড বা ম্যানেজমেন্ট যদি পাশে দাঁড়ায়, তার শক্তির জায়গা বেড়ে যায়। ক্রিকেট বোর্ড থেকে যদি বলা হয় সে অফ ফর্মে কিন্তু তার সামর্থ্য আছে। সাধারণ এই কথাটা বললেও খেলায়াড় সাহস পায়। তো এখানে বিভিন্ন রকম কথা হতে পারে, ধরন আছে। কিন্তু ক্রিকেটারদের পক্ষেও কিছুটা থাকতে হবে। আর পক্ষেও না থাকেন, ক্রিকেটারের বিষয়ে আপনার মিডিয়ার সামনে আসতে হবে কেন? আপনাকে প্রশ্ন করতেই পারে মিডিয়া, আপনার উত্তর দেওয়ার দরকার কী এই বিষয়ে। সব বিষয়ে কেন আপনি উত্তর দেবেন? বলতেই পারে মুস্তাফিজ ফর্মে নেই, আপনার কী মতামত। এই মতামত দেওয়া তো আমার দায়িত্ব না। এটা দেওয়ার জন্য টেকনিক্যাল, কোচ আছেন, তারা দেবেন। সব প্রশ্নের উত্তর কেন আমাকে দিতে হবে? এই জন্য বলছি বেশি কথা বললেই সমস্যা বেশি হয়।