ভারতে টিকা রপ্তানি স্থগিত হওয়ায় চীনের দিকে ঝুঁকছে উন্নয়নশীল বিশ্ব
জাতিসংঘ সমর্থিত এবং পশ্চিমা অনুদানপ্রাপ্ত ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইনের জরুরি টিকা সরবরাহকারী দেশ ভারত। গত শুক্রবার দেশটি সাময়িকভাবে ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করায় টিকা সংগ্রহকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরবরাহ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
দেশের অভ্যন্তরে নতুন করে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভ্যাকসিন সরবরাহে লাগাম টেনে ধরেছে ভারত। ফলে, ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নামা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ বেড়েছে। টিকা সংগ্রহের জন্য এখন চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে দেশগুলো।
ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেরাম ইন্সটিটিউট, ইতিমধ্যেই কোভ্যাক্সের মাধ্যমে ৬৪টি উন্নয়নশীল দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সরবরাহের চুক্তি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দুইটি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশসমূহে ভ্যাকসিন সরবরাহের উদ্যোগটি গৃহীত হয়।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা ইতিমধ্যে ৬০টির অধিক দেশে ভারতে তৈরি দুই কোটি ৮০ লাখ ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। তবে নতুন স্থগিতাদেশের ফলে, মার্চ ও এপ্রিলে আরও নয় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরবরাহে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এর আগে বিশ্বের বহু দেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভ্যাকসিন কিংবা ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
ভ্যাকসিন রপ্তানি সংশ্লিষ্ট একজন ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৭৫টির বেশি দেশে কোভ্যাক্সসহ ভারতে তৈরি ছয় কোটির বেশি টিকা রপ্তানি করা হয়েছে। অন্য কোনও দেশ থেকে এত ভ্যাকসিন সরবরাহ হয়নি।
এদিকে, পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফয়সাল সুলতান জানান, পাকিস্তান কোভ্যাক্সের উপর নির্ভর করে দেশটির টিকাদান কর্মসূচী জোরদার করতে চেয়েছিল। মার্চের শুরু থেকেই সরবরাহের কথা থাকলেও এখন কবে নাগাদ ভ্যাকসিন পৌঁছাবে তা অনিশ্চিত। ফলে, ভ্যাকসিনের জন্য দেশটি এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে।
কোভ্যাক্স থেকে টিকা সররাহের প্রথম ধাপে পাকিস্তানের সব থেকে বেশি এক কোটি ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাবার কথা ছিল। মে মাসের শেষ নাগাদ সব ভ্যাকসিন আসার কথা ছিল। তবে, সময়মতো না হলেও ভ্যাকসিনগুলো এ বছরই আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডক্টর সুলতান।
পাকিস্তানে এখন করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে। গত গ্রীষ্মের পর থেকে বর্তমানে পাকিস্তানে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সবথেকে বেশি। এখন পর্যন্ত পাকিস্তানে কেবলমাত্র চীনের ভেট হিসেবে আসা ১৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ব্যতীত অন্য কোনো টিকা আসেনি। টিকাগুলো কেবলমাত্র স্বাস্থ্যকর্মী এবং বয়স্কদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাকিস্তান এখন চীনের কাছ থেকে কয়েক লাখ ভ্যাকসিন কেনার কথা ভাবছে। কিন্তু শেষ মুহুর্তের এই উদ্যোগে আগামী মাসগুলোর জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত হবে কি না তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশটির কর্মকর্তারা।
আফ্রিকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) টিকাদান কর্মসূচীর পরিচালক রিচার্ড মিহিগো জানান, কোভ্যাক্সের পেছনে থাকা ডব্লিওএইচও এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো ভারত সরকারের সাথে গভীরভাবে আলোচনা করেছে। ভারত যেন অন্তত মার্চ ও এপ্রিল মাসে বরাদ্দকৃত ভ্যাকসিন চালান দেয় সে বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে।
কোভ্যাক্স জানায়, প্রতিষ্ঠানটি এ বছর ৯২টি উন্নয়নশীল দেশে ২০০ কোটি ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে ইচ্ছুক। যদিও তা শুরু হবে কিছুদিন পর থেকে।
কোভ্যাক্সের লক্ষ্য উন্নয়নশীল দেশের সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে এ বছর টিকাদানের আওতায় আনা।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের জনগণের প্রয়োজনের চাইতে বহুগুণ বেশি ভ্যাকসিন ডোজ কিনেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহা পরিচালক টেড্রস আধানম গেব্রিয়াসুস ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে বিদ্যমান এই বৈষম্যকে 'উদ্ভট' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। শুক্রবার এক বার্তায় তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভ্যাকসিন ক্রয়কারী ধনী দেশগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে অন্যান্য দেশে টিকার ডোজ দান করার আহ্বান জানান। এছাড়াও ভারত যেন দেশের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় রেখে অন্য দেশগুলোর সরবরাহ চাহিদা পূরণ করতে পারে, সে বিষয়েও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ভ্যাকসিন সরবরাহের তথ্য সংগ্রহকারী ডিউক ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তা অ্যান্ড্রিয়া টেইলর জানান, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ চীনের কাছ থেকে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন কেনার কথা নিশ্চিত করেছে। তবে টিকাগুলো আগামী কয়েক মাসের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাবে কি না তা এখনো নিশ্চিত নয়।
এক ইমেইল বার্তায় টেইলর জানান, "ভারত এবং বিশেষ করে সেরাম ইন্সটিটিউট বৈশ্বিক দক্ষিণে ভ্যাকসিন সরবরাহের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ফলাফল আগে থেকেই অনুমেয় ছিল। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ভারতও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে প্রাধান্য দিবে।"
- দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অবলম্বনে