আমি আনস্মার্ট থাকতে চাই: তৌকীর আহমেদ
২৬শে মার্চ শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকীর আহমেদের ৭ম চলচ্চিত্র 'স্ফুলিঙ্গ'। দেশের ৩৫টি সিনেমা হলে দেখা যাচ্ছে ছবিটি।
ছবি মুক্তির আগে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের মুখোমুখি হয়েছিলেন তৌকীর। চলচ্চিত্রসহ তার আরও কিছু কাজ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার
টিবিএস: যতদুর শুনেছি 'স্ফুলিঙ্গ' খুব অল্প সময়ের জার্নি আপনার। এত অল্প সময়ের জার্নিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ কি ঠিকঠাক হয়েছে?
তৌকীর আহমেদ: শুটিংয়ের জার্নিটা হয়তো অল্প সময়ের; কিন্তু দুইমাস ধরে আমি যখন আমেরিকায় বসে স্ক্রিপ্টটা লিখেছি, তখন কিন্তু সময় লেগেছে। স্ক্রিপ্ট লেখার আগে ভাবতে হয়েছে, গল্পটা সাজাতে হয়েছে- এটাও তো একটা বড় সময়। তবে ওই সময় করোনাভাইরাস ছিল; তাই কাজের অনেকটা সুযোগ পেয়েছি। তবে যখন সবকিছু চূড়ান্ত হয়, তখন প্রযোজকদের কথা ছিল, ছবিটা মার্চে মুক্তি দিতে হবে।
মার্চে যদি মুক্তি দিতে হয়, তাহলে আমাকে ডিসেম্বরের মধ্যেই শুটিং শেষ করতে হবে। এ কারণে শুটিংয়ে আমরা সময় কমাতে ও সহজ করতে একটা পরিকল্পনা করলাম। ইনডোর শুটিংয়ের জন্য একটা জায়গা নির্ধারণ করলাম। সেটা গাজিপুরের নক্ষত্রবাড়ি। সেখানেই ৫-৭টা বাড়ির সেট, থানা জেলখানা- সব এক জায়গায় করে ফেললাম। সেখানে টানা শুটিং করলাম। এ কারণে সময়টা কম লেগেছে।
তারপরও আউটডোরে যেতে হয়েছে; যেমন, গাজিপুরের কাপাসিয়ায় শীতলক্ষা নদীতে। ক্যাম্পাসের দৃশ্য ধারনের জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিলাম। এগুলো নক্ষত্রবাড়ি থেকে খুব কাছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটা বাসে শুটিং করা জরুরি ছিল। সেই বাস ছিল মানিকগঞ্জে। সেটা গাজিপুরে আনা যাবে না। ইঞ্জিন কন্ডিশন ভালো না। আবার কাগজপত্র নাই। তাই পুরো টিম সেখানে গিয়ে শুটিং করতে হয়েছে। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় যেতে হয়েছে গানের দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য। সেখানে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়।
আসলে চলচ্চিত্রের জন্য যা দরকার, সেটা করেছি। করোনাকাল মাথায় রেখে সেটা যতটা কাছাকাছি করা যায়, ততটা কাছে ও দ্রুত করার চেষ্টা করেছি। সব মিলিয়ে মোট ২৬ দিন শুটিং করেছি। তারপর এডিটিং, কালার গ্রেডিং, ডাবিং করে মুক্তি দিলাম।
টিবিএস: 'স্ফুলিঙ্গ' নির্মাণ করতে গিয়ে করোনা একটা বড় বাধা ছিল। আর কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
তৌকীর আহমেদ: হ্যাঁ, হয়েছিলাম। আমাদের দেশে পিরিয়ড কাজ করতে গেলে সবচেয়ে বড় সমস্যা, ওই সময়ের জিনিসপত্র পাওয়া যায় না। যেমন, আমরা ওই সময়ের পুরোনো কোনো ভবন সংরক্ষণ করিনি। চলচ্চিত্রে দরকার হলে কোথায় যাব? তাই বানিয়ে নিতে হয়। আবার, যদি ১৯৭১ সালের কয়েকটা গাড়ির দরকার হয়, সেটা পাওয়া কঠিন। যা-ও আছে দুয়েকটা, সেগুলো এই করোনার মধ্যে পাওয়া কঠিন। ওই সময়ের অস্ত্র পাওয়া কঠিন। সব মিলিয়ে জিনিসপত্র ও প্রপসের একটা স্বল্পতা ছিল।
টিবিএস: 'স্ফুলিঙ্গ' কি পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের গল্প?
তৌকীর আহমেদ: পুরোটা না; কিছুটা রয়েছে। এটা আসলে বোধ তৈরির গল্প। যেমন, ১৯৭১ সালে একজন তরুণ কী করত? আর এই সময়ের একজন তরুণ কী করে? তখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে একদল তরুণ ছুটে গিয়েছিল। এখনকার তরুণরা কী করছে? এটাই বোঝানো হয়েছে।
টিবিএস: আপনার চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীরা কেমন অভিনয় করেছেন?
তৌকীর আহমেদ: বেশ ভালো করেছেন। আমি সবসময় ভালো অভিনয়শিল্পীদের ওপর নির্ভর করি। আমার চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ অভিনয়শিল্পী মঞ্চ, টেলিভিশনের হয়ে থাকেন। চলচ্চিত্রেরও কিছু থাকেন। তারা সবাই নিজের সেরাটা দিয়েই কাজ করেন। সবাই তো আসলে ভালো কাজ চায়। শিল্পীদের মধ্যে একটা ক্ষুধা থাকে। দিন যত যায়, শিল্পী তত ম্যাচিউর হন এবং তার ভেতর ক্ষুধা তৈরি হয়। একজন শিল্পী যখন একটা ইউনিটে যান এবং দেখেন, সেখানে একটা ভালো কাজের চেষ্টা হচ্ছে বা ভালো কাজ হচ্ছে, তিনি তখন প্রকৃতির মতো সেখানে সাপোর্ট করেন। আমার বেলায় সেটা হয়েছে।
টিবিএস: আপনার চলচ্চিত্রগুলোর প্রচারণা কম। এর কারণ কী?
তৌকীর আহমেদ: এটার কারণ আসলে দুটো। হাইপ ওঠানো বা প্রচারণা করার জন্য তো টাকা দরকার। কিন্তু আমার সিনেমার তো ওই পরিমাণ বাজেট থাকে না। দ্বিতীয়ত, আমি নিজে একটু প্রচারবিমুখ মানুষ। আমি মনে করি, প্রচারণা আমার কাজ না। এটা একটা তৃতীয়পক্ষের কাজ। কোনো এজেন্সির কাজ। তাছাড়া ওটা করার জন্য যতটা স্মার্টনেস দরকার, সেটা আমার নাই। এবং এটাও বলতে চাই, আমি আনস্মার্ট থাকতে চাই। সেলসম্যন হতে চাই না বা পারব না।
এটার কারণ আছে। আমি যদি স্মার্ট হয়ে যাই, তাহলে আমার মাথায় কোনো গল্প আসবে না। আমার মধ্যে তখন বাণিজ্য আসবে। আমার মধ্যে সৃজনশীলতার চেয়ে বিপণনটা বেশি আসবে। এটা আমার চাওয়া নয়।
টিবিএস: কিন্তু আপনি নিশ্চয় চান ছবিটি সব ধরনের দর্শক দেখুক?
তৌকীর আহমেদ: অবশ্যই সেটা চাই। না হলে সিনেমা বানাই কেন? নিজের জন্য তো না। আমি সিনেমা বানাই দর্শকের জন্য। সবসময় একটা কথা বলি, সিনেমায় আমি কাজটুকু করি, সেটা ৫০ ভাগ। মানে বানানোটা। বাকি ৫০ ভাগ দর্শকের। মানে দেখাটা। দর্শক সিনেমা দেখবে, কথা বলবে, ভালো না লাগলে গালি দেবে। সমালোচনা করবে। আলোচনা করবে। এটাই তো আমার চাওয়া।
টিবিএস: আপনি নানা বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যেমন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে 'জয়যাত্রা', ভাষা আন্দোলন নিয়ে 'ফাগুন হাওয়ায়', আবার প্রবাসীদের নিয়ে 'অজ্ঞাতনামা', নদীর জীবন নিয়ে 'হালদা'। সিনেমা নির্মাণের এই ভাবনাগুলো কখন কীভাবে মাথায় আসে?
তৌকীর আহমেদ: এটা আসলে ভাবতেই থাকি। এখনো আমি ৫টা গল্পের আইডিয়া মাথায় নিয়ে ঘুরছি, ভাবছি। বলতে পারেন, রান্না করছি। ভাবতে ভাবতেই এগুলো ম্যাচিউর হয়। একটা উদাহরণ দেই। 'অজ্ঞাতনামা' চলচ্চিত্রের চিন্তাটা প্রথম করি নির্মাণের ৫-৬ বছর আগে। তারপর ওই ঘটনার সংক্রান্ত খবর যখন যেখানে পেয়েছি, জোগাড় করেছি। পেপার কাটিং রেখেছি। মোটকথা, একটা বড় রিসার্চ করতে হয়েছে। এ রকম সব ছবির বেলাতেই করার চেষ্টা করি। এভাবে রিসার্চ ভাবনা ম্যাচিউর হলে তবেই লিখতে বসি। তার আগে না। এটা চলতে থাকে।
টিবিএস: পরিচালক তৌকীর আহমেদ কি তার জীবনের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ফেলেছেন?
তৌকীর আহমেদ: না। অসম্ভব। মানুষ জীবদ্দশয়ায় কি এটা বানাতে পারে? আমিও পারিনি। তবে আগের সিনেমার ভুল ত্রুটি পরের সিনেমায় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। আমার সব কাজ যে ভালো হবে, সেটা বলছি না। কারণ, একজন পরিচালকের ভালো করার যেমন চেষ্টা আছে, তেমনি ভুল করার বা খারাপ করারও অধিকার আছে।
টিবিএস: বিভিন্ন সময়ে চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার বলা কথাগুলো অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকেই শেয়ার করছেন। ব্যাপারটা কেমন লাগছে?
তৌকীর আহমেদ: আমিও কিছু দেখেছি। একদিক দিয়ে ভালো। তরুণ প্রজন্ম চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলছে, চিন্তা করছে। সিনেমা নিয়ে কিন্তু মানুষের আকর্ষণ চিরন্তর। মানুষ ছোটবেলাতেই সিনেমা দেখে এবং ভালো সিনেমার ইমেজ তার মাথার মধ্যে রয়ে যায়। সিনেমার শক্তি ও সিনেমার আকর্ষণের কারণেই মানুষের ওপর সিনেমার একটা প্রভাব পড়ে।
আমার মনে হয়, আমাদের দেশে যেহুতু সিনেমা নির্মাণ শেখার জন্য ফরমাল কোনো ইনস্টিটিউশন তৈরি হয়নি, তাই যেসব তরুণ সিনেমা নির্মাণ শেখার জন্য হাতড়ে বেড়ান, তাদের এগুলো কাজে লাগবে। তারা উৎসাহিত হবেন। কেউ যদি 'ফাগুন হাওয়ায়', 'হালদা' কিংবা 'অজ্ঞাতনামা' দেখে উৎসাহিত হন, তাহলে এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি।