অবকাঠামো উন্নয়নে কোরিয়ার কাছ থেকে ২১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পাওয়ার প্রত্যাশা বাংলাদেশের
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ এবং দেশের প্রথম সাবওয়ে ও ঢাকা সার্কুলার রেলওয়ে-সহ বেশ কিছু প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে অন্তত ২১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের এ সপ্তাহেই ঢাকায় আসার কথা থাকলেও বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে আচমকা করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সেই সফর বাতিল হয়েছে।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের মধ্যে ভার্চুয়ালি আলাপ আগাবে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষ এবং দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান- কোরিয়া ওভারসীস ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড আরবান ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের (কেআইএনডি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকলিপি স্বাক্ষর হয় সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের ব্যাপারে। সেইসঙ্গে এই যৌথ উদ্যোগ এরই মধ্যে বেশকিছু প্রজেক্টের সম্ভাব্য অর্থায়নের ব্যাপারে আলোচনা করেছে।
সাতটি অবকাঠামোগত প্রজেক্টের বিষয়ে কোরিয়ার দলটি পিপিপি কর্তৃপক্ষ ও বাস্তবায়নকারী এজেন্সিগুলোর সঙ্গে ভার্চুয়ালি আলোচনায় বসবে বলে নিশ্চিত করেছে পিপিপি কর্তৃপক্ষ।
কোরিয়া ওভারসীস ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড আরবান ডেভলপমেন্টের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হাংকিয়ু লিম এই আলোচনায় কোরিয়ার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। তবে বৈঠকের তারিখ এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানা যায়।
সাতটি প্রজেক্টের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩টি প্রজেক্ট রয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের যার আনুমানিক খরচ ১১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ ও ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি লিমিটেডের একটি করে প্রজেক্ট রয়েছে।
পিপিপি কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রস্তাবিত এই প্রজেক্টগুলো দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পিপিপির অধীনে বিনিয়োগ হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপর চাপ কমবে।
পরিকল্পনা কমিশনের জেনারেল ইকোনমিকস ডিভিশনের (জিইডি) সদস্য ডা. শামসুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন মাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে ৯২৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের একটি বিশাল রিসোর্স গ্যাপের সম্মুখীন।
তিনি পিপিপি পদ্ধতির মাধ্যমে ৫১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার বা ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ সংগ্রহের মাধ্যমে এই রিসোর্স গ্যাপ কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন।
এদিকে পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতানা আফরোজ জানিয়েছেন, কোরিয়ান বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে সরকার থেকে সরকার পর্যায়ে (জি টু জি) বিনিয়োগের জন্যে তারা কেআইএনডি'র সঙ্গে ২০১৯ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন।
তিনি আরও জানান, পিপিপির যৌথ প্ল্যাটফর্ম থেকে দুই দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনটি বৈঠক হয়ে হয়ে গেছে।
'তবে করোনা মহামারির কারণে বর্তমানে প্রজেক্টগুলোর অগ্রগতি স্থগিত হয়ে আছে। আমি আশা করি, মহামারির মধ্যেও এই প্রজেক্টগুলোর কাজ আবার শুরু করার জন্যে একটা উপায় আমরা খুঁজে বের করতে সক্ষম হব', বলেন সুলতানা আফরোজ।
কোরিয়ার অর্থায়নে সাবওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে ও সার্কুলার ঢাকা রেলপথ তৈরি
টঙ্গি ও ঝিলমিল এলাকাকে সংযুক্ত করে ২৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ, দেশের প্রথম সাবওয়ে নির্মাণের জন্যে কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ।
এর পাশাপাশি, ঢাকা সার্কুলার রেলওয়ে, ঢাকা ইস্ট ওয়েস্ট ইলেভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ভুলতা থেকে আড়াইহাজার যোগাযোগ পথে মেঘনা নদীর ওপর একটি সেতু এবং ঢাকা-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রুটকে এক্সপ্রেসওয়েতে রূপান্তর করার প্রজেক্টগুলোর অর্থায়ন করবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ।
গত বছরের নভেম্বরে পিপিপি প্ল্যাটফর্মের তৃতীয় ও সর্বশেষ বৈঠকে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ টঙ্গি থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রথম সাবওয়ে নির্মাণের জন্য কোরিয়াকে ৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কোরিয়া সরকার ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে কেরানিগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত প্রথম লাইন স্থাপনের প্রস্তাব জানায়।
বাংলাদেশ সেতু বিভাগের সেক্রেটারি বেলায়েত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২৫৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টঙ্গি-ঝিলমিল সাবওয়ে হবে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দেশে ১১টি সাবওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম সাবওয়ে।
এছাড়াও বাংলাদেশ ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-মাওয়া হাইওয়েকে সংযুক্ত করতে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ইলেভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতেও আগ্রহী।
২ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্ট ঢাকার জ্যাম এড়িয়েই চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমের জেলাগুলোকে সংযুক্ত করতে সাহায্য করবে।
প্রজেক্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, এটি পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে যান চলাচল করতে দিবে এবং দক্ষিণ থেকে চট্টগ্রাম ও উত্তর থেকে জয়দেবপুর ও ঢাকার উপকণ্ঠে টাঙ্গাইল এবং সেখান থেকে সামনের দিকে ময়মনসিংহের মত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
এর আগে মালয়েশিয়া ও চীন এই অবকাঠামোগত প্রজেক্টগুলোতে অর্থায়নের জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করলেও সরকার কোরিয়াকে বেছে নিয়েছে।
গত বছর কোরীয় কোম্পানিগুলো ৮০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা সার্কুলার রেলওয়ে নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই প্রজেক্টে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসবে কোরিয়ার প্রতিনিধি দল।
ভারতের সঙ্গে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করবে মেঘনা নদীর ওপর নতুন ব্রিজ
ভুলতা-আড়াইহাজার থেকে বাঞ্চারামপুর হয়ে ভারতের আগরতলাকে ঢাকার সঙ্গে সংযুক্ত করতে সরকার মেঘনা নদীর ওপর আরও একটি সেতু নির্মাণ করতে চায় বলে জানা গেছে। তাছাড়া, এই সেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের দিকে একটি বিকল্প রুট তৈরি করবে।
সেতু বিভাগের সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা থেকে জানা যায়, ১ দশমিক ৬৮ কিলোমিটারের চার লেন বিশিষ্ট ও ২২ কিলোমিটারের অভিগমন পথসহ এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হতে পারে ৭ হাজার ৪৬৩ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা। এই প্রজেক্টে অর্থায়নের জন্যে কোরিয়ার কাছে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাইবে বাংলাদেশ সরকার।
পূর্বাচলে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক
পূর্বাচল নিউ টাউন এলাকায় একটি আধুনিক ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থা স্থাপন করার পরিকল্পনা করছে সরকার। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) করা সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণা থেকে জানা যায়, এ প্রকল্পে ব্যয় হতে পারে ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
ডেসকোর উন্নয়ন বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী জুলফিকার তাহমিদ জানান, এ প্রজেক্টে বিনিয়োগের জন্যে ইতোমধ্যে একটি কোরীয় কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে।
'এটি একটি বিরাট প্রজেক্ট এবং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। সেকথা বিবেচনা করে আমরা বিদ্যুৎ বিভাগকে একটি প্রাথমিক ডিপিপি (ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) পাঠিয়েছি', বলেন জুলফিকার তাহমিদ।