বিশ্বে করোনার নতুন ঢেউ কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ?
মহামারি শুরু হওয়ার পর কেটে গেছে দীর্ঘ এক বছর। বিশ্বের অনেক দেশেই কয়েক মাস ধরে জোরালোভাবে চলছে টিকাদান কার্যক্রম। তবে টিকার চালান প্রাপ্তি নিয়ে বৈষম্য থাকায় অনেক দেশেই ব্যাহত হচ্ছে জাতীয় টিকা কর্মসূচি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এর ভুক্তভোগী। অনেক দরিদ্র দেশ শুধুমাত্র বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স কর্মসূচির মাধ্যমেই চালান পাওয়ার অপেক্ষা করছে।
এরমধ্যে, কিন্তু প্রাণঘাতী জীবাণুর অভিযোজনও থেমে নেই। প্রতিনিয়ত আরও সংক্রামক ও প্রাণঘাতী ধরনের জীবাণুর বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন ধরা পড়ছে বিশ্বব্যাপী। এরমধ্যে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে শনাক্ত কয়েকটি ধরন বেশ শক্তিশালী। এগুলো বিদ্যমান প্রতিষেধকের কার্যকারিতা দুর্বল করে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে ইতোমধ্যেই। এবং খুব শিগগির সম্পূর্ণভাবে প্রথম প্রজন্মের কোভিড-১৯ টিকার প্রভাব মোকাবিলা করে টিকে থাকার মতো জীবাণুর ধরন দেখা দিবেও বলে আশঙ্কা করেছেন শীর্ষ বিজ্ঞানীরা।
মহামারি, জীবাণু এবং সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সাম্প্রতিক এক জরিপ চালানো হলে, তাদের অধিকাংশই সেখানে এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
সমীক্ষাটি পরিচালনাকারী জোট- পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স একথা নিশ্চিত করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম এবং ইউএনএইডস- এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই জোটের সদস্য। ২৮টি দেশের ৭৭ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর মধ্যে জরিপ চালানো হয়। তাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মনে করছেন, প্রথম প্রজন্মের ভ্যাকসিন অকার্যকর হওয়ার আগে ৯ মাস বা তারও কম সময় পাওয়া যাবে। আর দুই-তৃতীয়াংশ বলেছেন, আর এক বছর, বা তার চাইতেও কম সময় আছে।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কথা হলো দেশে-বিদেশে যেভাবে টিকাদানের মধ্যেই নতুন করে সংক্রমণের ঢেউ দেখা দিয়েছে, সেখানে ইতোমধ্যেই নতুন ধরনগুলোই সংক্রমণের প্রধান উৎস হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও তেমন কিছু হয়েছে কিনা- তা অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গবেষণার মাধ্যমে জানাননি। কিন্তু, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেই ভয়টিই করছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে জোরালো টিকা কর্মসূচির একটি চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন ধরনের হুমকির ক্ষেত্রে দেশটির উদাহরণ দেওয়া তাই খুবই প্রাসঙ্গিক হবে।
সেখানে এলটিসি (লং টার্ম কেয়ার) সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিকদের টিকাদানের আওতায় আনা হয়েছে। এর বাইরে এক কোটি মানুষ টিকা নিয়েছেন। অন্যদিকে, আরও এক কোটির বেশি মানুষ টিকা না নিলেও ইতোমধ্যে আক্রান্ত হওয়ায় তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু, বিশাল সংখ্যক মানুষকে সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা সত্ত্বেও শুরু হয়েছে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে সংক্রমণ সংখ্যা বৃদ্ধির সংবাদ আসছে। তবে বিভিন্ন স্থানের পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের এই ওয়েভকে সর্বজনীন বলে মনে হচ্ছে না।
সংক্রমণের শীর্ষে থাকা মিশিগানের দিকে লক্ষ্য করা যাক। সংক্রমণের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকার পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ভিড়। ঠিক আগের ঢেউয়ের মতোই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি সত্যিই আশ্চর্যজনক। বয়স্ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ এতগুলো মানুষকে টিকাদানের পরও সংক্রমণ সংখ্যা বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা হ্রাস পায়নি।
প্রতিরোধক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভাইরাসটি এখন আর ঝুঁকিপূর্ণ নয়। উদাহরণ হিসেবে ওয়াশিংটন স্টেটের কথা বলা যেতে পারে। এখানে টিকা নেওয়া ১২ লাখ মানুষের মধ্যে ১০০ জনের সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে মাত্র আট জনকে। কিন্তু, যারা এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণ করেননি, তাদের জন্য ভাইরাসটি আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ আছে।
মহামারির নতুন এক ধাপে প্রবেশ করতে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে আমরা সংক্রমণ বৃদ্ধির সময়গুলোকে 'ওয়েভ' কিংবা 'ঢেউ' হিসেবে বর্ণনা করেছি। কিন্তু, এখন পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে সবথেকে উপযুক্ত শব্দ হবে 'টর্নেডো'। কিছু জনগোষ্ঠী হয়তো ঝড়টা দেখবে না। অনেকেই আবার এই দুর্যোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু, সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো টর্নেডোর আঘাতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
ভাইরাসটি কখনোই সব জায়গায় সমানভাবে আঘাত হানেনি। তবে, ভাইরাসের নতুন ধরনের উৎপত্তি হওয়ায় টিকাদানের পর কেবলমাত্র কিছু জায়গায় মহামারির অবসান ঘটবে। শীঘ্রই সম্পদশালী এবং অধিক হারে টিকা গ্রহণকারী জনগোষ্ঠীগুলো মহামারির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে। যেখানে টিকাদানের হার কম, সেখানে ঝুঁকির পরিমাণও বেশি। সাড়ে পাঁচ লাখ মৃতের তালিকায় আরও কিছু নাম যুক্ত করতে চলেছে এসব অঞ্চল।
বিভিন্ন শহরে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লেও, সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। মিশিগানে ছোটখাটো কিছু শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত কাউন্টিতে ভ্যাকসিনেশনের হার ডেট্রয়েটের তুলনায় দ্বিগুণ। অন্যদিকে, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে টিকাদানের হার যেমন কম, তেমনি সংক্রমণের হারও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সার্ডে ডেটার তথ্যানুসারে, মাস্ক পরিধান এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা বিষয়ক রাজনৈতিক মত-পার্থক্যের দিক থেকে রিপাবলিকান এবং ইভানজেলিকাল খ্রিস্টানদের মাঝে ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রবণতা সবথেকে কম। ফিলাডেলফিয়ার যেসব অঞ্চলে শিক্ষার হার কম এবং শ্বেতাঙ্গদের বাস বেশি, সেখানে গত ৩০ দিনে সংক্রমণের হারও বেশি। বাল্টিমোরে সংক্রমণ সংখ্যা বাড়লেও তথ্য-উপাত্ত অগোছালো। দেশটিতে সংক্রমণের শীর্ষে থাকা অঞ্চলগুলোতে তীব্র এই সংকট প্রতিরোধ করতে স্বাস্থ্যকর্মীদের বিদ্যমান সকল সরঞ্জামাদি নিয়েই মাঠে নামতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সিডিসি পরিচালক রোশেল ওয়ালেনস্কি সোমবার সাপ্তাহিক প্রেস কনফারেন্সে আমেরিকানদের জানান, তার বারবার শুধু আসন্ন এক মহাপ্রলয়ের কথাই মনে হচ্ছে। তিনি, চতুর্থ ওয়েভ প্রতিরোধে দেশবাসীকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান। সেইসাথে, গত কয়েক সপ্তাহে জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সে মহামারি যে নাটকীয় রূপ ধারণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রও একই পরিণতি বরণ করতে চলেছে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক অবলম্বনে