চীন কেন নতুন করে পশ্চিমা ভ্যাকসিন অনুমোদনের কথা ভাবছে?
জুলাইয়ের আগেই প্রথমবারের মতো দেশে বিদেশি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিতে চলেছে চীন। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় বিজ্ঞানী ও গবেষক এবং বিদেশি বাণিজ্য সংস্থার চাপের মুখে চীন এখন স্থানীয় ভাবে তৈরি ভ্যাকসিনের বাইরে অন্যান্য উচ্চ কার্যক্ষমতা সম্পন্ন বিদেশি ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
চীনা কর্মকর্তারা বর্তমানে জার্মান বায়োটেকনোলজি ফার্ম বায়োএনটেক এসই-র করোনা ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল ডেটাসমূহ খতিয়ে দেখছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয়ভাবে বায়োএনটেক ভ্যাকসিন বিতরণ ও টিকদানের বিষয়ে সবুজ সংকেত মিলবে।
দেশটির সরকার এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মিলিত এক গোপন বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা এ সকল তথ্য তুলে ধরেছেন। এছাড়া, সরকারি কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ এক আলোচনার সূত্র থেকেও একই তথ্য মিলেছে।
চীনের অধিকাংশ ভ্যাকসিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাইটে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ডেটা অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণ রোধে তাদের ভ্যাকসিনের পূর্ণাঙ্গ ডোজের কার্যকারিতা প্রায় ১০০ শতাংশের কাছাকাছি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে, এধরনের গুরুতর সংক্রমণও চীনা ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতিরোধ করা সক্ষম বলে দাবি করা হয়েছে। তবে দেশটির রোগ প্রতিরোধ সংস্থার প্রধানসহ কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মৃদু সংক্রমণ প্রতিরোধে অধিক কার্যকর পশ্চিমা ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে আসার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন।
সাংহাইয়ের আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কার গিবসের মতে, বিদেশ ভ্রমণ সহজ করতে বিদেশি বাণিজ্য সংস্থাগুলো পশ্চিমা ভ্যাকসিনের উপর জোর দিচ্ছে। কেননা, বাইরের দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পশ্চিমা ভ্যাকসিন গ্রহণ অধিক গ্রহণযোগ্য। সংগঠনটি ডিসেম্বর থেকেই চীনা সরকারের উপর ফাইজারের বায়োএনটেক ভ্যাকসিনের অনুমোদন প্রদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করে আসছে বলেও উল্লেখ করেন গিবস।
ডিসেম্বরে সাংহাই ফোসান ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপ করপোরেশনের সাথে চুক্তি করতে সম্মত হয় বায়োএনটেক। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালে চীনে ১০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন পাঠাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠান। তবে, সেই চুক্তির অনুমোদন প্রক্রিয়া এখনো বিচারাধীন।
কবে নাগাদ অনুমোদন মিলবে তা এখন পর্যন্ত নির্ধারিত নয়। চীনা ভ্যাকসিন বোর্ডের সিদ্ধান্তের উপর পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক কারণেই অনুমোদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বায়োএনটেককে বেইজিং কবে নাগাদ সবুজ সংকেত প্রদর্শন করবে তার পুরোটাই এখন চীনা ভ্যাকসিন বোর্ডের অনুমোদনের উপর নির্ভর করছে।
এদিকে, সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিনোফার্ম এবং বেসরকারি সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের ভ্যাকসিনের উপর পর্যালোচনা জারি রেখেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মে মাসের শুরুর দিকে সংস্থাটি ভ্যাকসিনগুলোর সম্ভাব্য জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিতে পারে। তবে, যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো চীনা ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেয়নি।
শুক্রবার চিলির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক কোটি পাঁচ লাখ মানুষের উপর গবেষণার ভিত্তিতে দেখা গেছে, সংক্রমণ রোধে সিনোভ্যাকের এক ডোজ ভ্যাকসিন মাত্র ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। তবে, দ্বিতীয় ডোজের পর এই কার্যকারিতার হার ৬৭ শতাংশ। সম্প্রতি, বায়োএনটেক এবং ফাইজারের উচ্চ কার্যক্ষমতা সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা গেছে যে, ফাইজার বায়োএনটেকের দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ প্রতিরোধে ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর।
বায়োএনটেক জানায়, প্রতিষ্ঠানটি চীনের অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে, ফোসান ফার্মাসিউটিক্যাল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতীয় মেডিকাল পণ্য প্রশাসনও এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থেকেছে।
এখন পর্যন্ত চীন সাধারণ ব্যবহারের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত চারটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। অন্যদিকে, জরুরি ব্যবহারের জন্য অপর একটি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও দেশটি টিকাদান বাড়াতে চলতি বছরের আগস্ট নাগাদ ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ প্রায় ৫৬ কোটি মানুষকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। তবে চীন টিকাদান কার্যক্রম শুধুমাত্র নিজেদের মাঝেই সীমিত রাখেনি, ইতোমধ্যেই তারা বিশ্বব্যাপী করোনা ভ্যাকসিন রপ্তানি শুরু করেছে। বিজ্ঞান-বিশ্লেষক সংস্থা এয়ারফিনিটির তথ্যানুসারে, চীন এবছর প্রায় সাড়ে ১১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন রপ্তানি করেছে। অধিকাংশ ভ্যাকসিন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরবরাহ করা হয়েছে।
পশ্চিমা ভ্যাকসিন অনুমোদনে বিলম্ব করায় বিপাকে পড়েছে চীনের বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাংহাইয়ের আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সাম্প্রতিক জরিপের তথ্যানুযায়ী, সংগঠনটির সদস্য প্রতিষ্ঠানের প্রায় চল্লিশ হাজার কর্মী জানায় যে তারা বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন গ্রহণে আগ্রহী।
চীনের জার্মান চেম্বার অব কমার্সের উত্তরাঞ্চল শাখার বোর্ড সদস্য আন্দ্রিয়াজ ফিজি জানান, "আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য শীঘ্রই ভ্যাকসিন অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে।"
"ভ্যাকসিনের যৌথ স্বীকৃতি প্রদানে কেবল বিদেশি বাণিজ্য সংস্থাগুলোই উপকৃত হবে না, বরং তা চীনা নাগরিকদেরও বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কাজে লাগবে," বলেন তিনি।
কর্মক্ষেত্রে ভ্যাকসিন পাসপোর্টের অনুমোদন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্তিত করতে পারস্পারিক ভ্যাকসিনের স্বীকৃতি প্রদান জরুরি বলে মন্তব্য করেন নিউ ইয়র্কের কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের সিনিয়র ফেলো ইয়ানজং হুয়াং। এজন্য, বেইজিং কর্তৃক বায়োএনটেক ভ্যাকসিন অনুমোদনের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
চীনে পশ্চিমা ভ্যাকসিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভবত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম ভ্যাকসিনকে জরুরি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উপর নির্ভরশীল বলে মন্তব্য করেন হুয়াং। পাশাপাশি পশ্চিমা ভ্যাকসিনের স্বীকৃতি প্রদান বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনুমোদন প্রদানের বিষয়ে চীনকে আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মার্চের শেষ নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা প্যানেলের প্রধান আলেজান্দ্রো ক্যারাভিয়োটো জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্ত অনুযায়ী সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাক ইতোমধ্যে তাদের কোভিড ভ্যাকসিনের ৫০ শতাংশের অধিক কার্যকারিতা প্রমাণে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে।
- সূত্র: ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল