যে কারণে মহামারির পরও রয়ে যাবে লং কোভিডের প্রভাব
কোভিড-১৯ থেকে বেঁচে যাওয়া লাখো মানুষের মনে এখন জাগছে নতুন এক সন্দেহ। তারা মনে করছেন, করোনা থেকে পুরোপুরি মুক্তিলাভ যেন একটি অধরা ব্যাপার। সামান্য কোনো অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার সপ্তাহ কিংবা মাসের পর মাস পরেও রোগীরা নানা শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। 'দীর্ঘমেয়াদি কোভিড' বা লং কোভিড নামে পরিচিত এই অসুস্থতার স্থায়ীত্ব ও গভীরতা পরিমাপ করতে গিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, এধরনের রোগীর ভিড় সামলাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিশেষায়িত কোভিড ক্লিনিক খোলা হচ্ছে।
তাই বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মহামারির অতিমাত্রায় সংক্রমণ হওয়ার অর্থ হলো; লং কোভিড রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি, এমন রোগীর আধিক্যে মহামারি পরবর্তীকালে জনস্বাস্থ্য খাতে যেমন সম্পদের সঙ্কট দেখা দেবে, তেমনি শারীরিক অক্ষমতায় বাড়বে অর্থনৈতিক দৈন্যতা।
মহামারির এই মাত্রার ফলে সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও কোভিডের দ্বারা শারীরিক অক্ষমতা ও একই সাথে স্বাস্থ্য সম্পদের বিষয়ে প্রকট অর্থনৈতিক সমস্যা বজায় থাকবে।
১. অসুস্থতাগুলো কি কি?
অসুস্থতার সম্ভাবনা, পুনঃপুনঃ ফিরে আসার হার ও স্থায়ীত্ব সম্পর্কে ক্রমশ নানারকম তথ্য বেরিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে, সামান্য অসুস্থতা থেকে শুরু করে মানুষকে অক্ষম করে দেয়ার মত অসুস্থতাও। এই ধরনের অসুস্থতা SARS-CoV-2 সংক্রমিত হওয়ার চার সপ্তাহ বা তার পর থেকে দেখা যেতে পারে। অবসাদ, নিঃশ্বাসে সমস্যা, বুক ব্যথা, 'ব্রেইন ফগ' সহ কোনোকিছু মনে রাখতে না পারার সমস্যা এবং শরীর ব্যথা হওয়া যা স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যাঘাত ঘটাতে যথেষ্ট।
হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, মস্তিষ্কসহ শরীরের নানা অঙ্গের বিকলাঙ্গতার প্রমাণও প্রাথমিক রিপোর্টে পাওয়া গেছে। এমনকি যেসব ব্যক্তির মধ্যে করোনাভাইরাসের কোন উল্লেখযোগ্য লক্ষণও প্রকাশ পায়নি, তাদের কারো কারো ক্ষেত্রেও এ ধরনের সমস্যা দেখা গিয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লং কোভিড এর ফলে প্রাণঘাতী কোন উপসর্গ পাওয়া যায়নি। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে ১২৫০ জন রোগীর মধ্যে একটি পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যেই ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যক্তি মারা গেছেন। সেই সাথে ১৫ দশমিক ১ শতাংশের পুনরায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এবং তাদের কারো কারো ক্ষেত্রে অসুস্থতা গুরুতর বলে জানানো হয়েছে।
২. লং কোভিড কতটা প্রভাব ফেলে?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি, কারণ কোভিড-১৯ আমাদের কাছে একেবারেই নতুন একটি রোগ। যদিও হাসপাতালে নেওয়া ও না-নেওয়া রোগীদের মধ্যে এই ঝুঁকির মাত্রা কমবেশি হতে পারে। এছাড়াও, রোগীর অসুস্থতার মাত্রা, বয়স, লিঙ্গ, জাতি, আয় ও অন্তর্নিহিত অবস্থার উপরও ঝুঁকির মাত্রা নির্ভর করে।
তাছাড়া, গবেষকরা এখনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ণয়ের মতো যথেষ্ট পরিমাণ রোগী নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেননি। দীর্ঘমেয়াদি এমন অসুস্থতাকে চিকিৎসকরা বলে থাকেন 'পোস্ট-অ্যাকিউট সিকুইলে বা পিএএসসি'। এর দ্বারা নির্ণয় করা যায় যে, রোগী কতদিন ও কী মাত্রায় রোগে ভুগবে। তবে সাম্প্রতিক তথ্য ও বেঁচে যাওয়া রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল দাবি করা থেকে বোঝা যায়; ফুসফুসে ক্ষত, হৃদযন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি, ভাইরাস পরবর্তী অবসাদ ও অন্যান্য দুর্বলতার মত অসুখগুলোই মানুষের হতে পারে।
৩. হিসাব কি বলে?
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় থেকে গত ডিসেম্বরে হিসাব করা হয়, কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হওয়া মানুষদের ভেতরে প্রতি পাঁচজনে একজন ব্যক্তির ৫ সপ্তাহ বা তার বেশি এবং প্রতি দশজনে একজনের মধ্যে ১২ সপ্তাহ বা তার অধিক সময় ধরে লং কোভিডের উপসর্গ পাওয়া গেছে।
এছাড়াও, শীত বেড়ে যাওয়ার আগেই, গেল নভেম্বরে ইংল্যান্ডে প্রতি ১০ লাখের মধ্যে ১৮৬,০০০ জন কোভিড রোগী প্রায় ৫ থেকে ১২ সপ্তাহ শরীরের এসব উপসর্গ বয়ে বেড়িয়েছেন।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট একটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, কোভিড-১৯ দ্বারা তীব্রভাবে আক্রান্ত হওয়ার পর নয় মাস পর্যন্তু শরীরে এসব উপসর্গ থাকে। ২৪০,০০০ জন কোভিড রোগীকে নিয়ে করা আরেকটি বৃহত্তর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি তিনজনে একজন রোগীকে আক্রান্ত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই একটি নিউরোলজিক্যাল বা সাইকিয়াট্রিক রোগনির্ণয় পরীক্ষা করাতে হয়েছে।
৪. এসব লক্ষণের পেছনে কি সত্যিই কোভিডই দায়ী?
না, কেবল কোভিডই আবশ্যিকভাবে দায়ী নয়। এক্ষেত্রে কোনটি আসলেই SARS-CoV-2 সম্পর্কিত অতীত সংক্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্ত আর কোনটি মহামারির ফলে অবসাদ বা উদ্বেগ, তা বুঝতে পারা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুইডিশ একটি হাসপাতাল সাধারণ মাত্রায় করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছে (আট মাস আগে) এবং আগে কখনোই আক্রান্ত হয়নি- এমন দুই দল স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। ফলাফলে দেখা যায়, আক্রান্তদের মধ্য থেকে ৮ শতাংশ ব্যক্তি দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার লক্ষণ অনুভব করেছে, অন্যদিকে কখনোই সংক্রমিত না হওয়াদের মধ্যে এই মাত্রা ৪ শতাংশ। কোভিড পরবর্তী অসুস্থতা নিয়ে এই অনিশ্চয়তার ফলকে স্বাস্থ্যবিদরা 'মেডিক্যাল গ্যাসলাইটিং' বলে আখ্যা দিচ্ছেন।
৫. বৃহত্তর প্রভাবসমূহ কি কি?
কিছু গবেষকদের মতে, মহামারি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যাকে উস্কে দিতে পারে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ অনুভব (মিয়ালগিক এনসিফালোমিলিটিস বা এমই নামেও পরিচিত), ডিমেনশিয়া, পারকিনসন্স ডিজিজ, ডায়াবেটিস ও কিডনির ক্ষতি।
৬৮ দশমিক ৯ শতাংশ কর্মঘন্টা কমে যাওয়াও প্রমাণ দেয় যে, মহামারি আমাদের শ্রম উৎপাদন ক্ষমতাকে বিনষ্ট করছে। সারা বিশ্বে ১৩৬ মিলিয়ন কোভিড রোগীর মধ্য থেকে একটি ছোট অংশও যদি দীর্ঘস্থায়ী দুর্বলতায় ভুগে, তাহলেও তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাপক নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম। আর করোনাভাইরাসজনিত অসুস্থতা যদি মানুষ বছরের পর বছর বা কয়েক দশক ধরে বয়ে বেড়ায়, তাহলে তার পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ।
৬. অন্যান্য ভাইরাস কি দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কারণ হতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে-হ্যাঁ। সাধারণ ঠান্ডা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইচআইভি, ইনফেকশাস মনোনিউক্লিওসিস, হাম ও হেপাটাইটিস বি-এর মত নানা ধরনের ভাইরাস আক্রান্ত হলে তা থেকে ভাইরাস পরবর্তী উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) থেকে টিকে থাকা মানুষদের পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা ডায়াবেটিস ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা পেয়েছেন তাদের শরীরে। কানাডীয় একটি গবেষণায় টরেন্টোর ২১ স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে সার্স আক্রান্ত হওয়ার তিন বছর পরেও ভাইরাস সংক্রমণ-পরবর্তী উপসর্গ পাওয়া গেছে এবং তারা কাজেও ফিরতে পারেননি।
২০১০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হংকং-এ সার্স আক্রান্তদের মধ্যে যাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল দুবছর পরেও তাদের ফুসফুসে জটিলতা দেখা গিয়েছে। তারপরেও সার্স ভাইরাসের একই রকম প্রভাব কোভিডের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে কিনা- তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
৭. কি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
কোভিড-১৯ এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে ১১৫ কোটি ডলারের তহবিল দিচ্ছে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)।
আশা করা হচ্ছে গবেষণায় নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর উঠে আসবে:
- সকল বয়সীদের মধ্যে সেরে ওঠার পার্থক্য কেমন ছিল? দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার ক্ষেত্রে এর অনুপাত কত ছিল?
- দীর্ঘমেয়াদি এসব সমস্যার পেছনের জৈবিক কারণ কি হতে পারে? সেগুলো কিভাবে প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যাবে?
- অন্যরা যেখানে দ্রুত সেরে উঠছে সেখানে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অসুস্থতাপ্রবণ হয়ে ওঠার কারণ কি?
- সার্স কোভ-২ সংক্রমণ কি শরীরে এমন কোন পরিবর্তন আনে যার ফলে আক্রান্তরা হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক বা অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতিসহ দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক সমস্যার শিকার হন?
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত
- অনুবাদক: খুশনূর বাশার জয়া