বিশ্বে নতুন ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাসে ভূমিকা রাখবে ভ্যাকসিন
বৈশ্বিক উত্তর হিসেবে পরিচিত উন্নত দেশগুলোর সাথে পিছিয়ে থাকা বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছে এই করোনা মহামারি। ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে ধনী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো গোষ্ঠীভিত্তিক অনাক্রম্যতা বা হার্ড ইম্যুনিটি অর্জনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। অন্যদিকে, আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ উদ্বৃত্ত ভ্যাকসিনের জন্য তাকিয়ে আছে ধনী রাষ্ট্রগুলোর দিকে।
বিশ্বে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। বাকি সব দেশের টিকাদান কর্মসূচী নির্ভর করছে এই গুটিসংখ্যক দেশের উপর। ফলে, সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস। নতুন এই বিন্যাসে বৈশ্বিকভাবে সৃষ্ট ভারসাম্যহীন নির্ভরশীলতার কারণে ভ্যাকসিনের চাহিদা ও সরবরাহে দেখা দিয়েছে অসামঞ্জস্যতা।
ইতোমধ্যে, ভ্যাকসিন সংকটে থাকা দেশগুলোর কূটনৈতিক চাপ ও প্রলোভনের মাঝে পড়ার ইঙ্গিত মিলেছে। রাশিয়া এবং চীন নিজেদের অনুকূলে থাকা পররাষ্ট্রনীতির বিনিময়ে ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু করেছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব অভ্যন্তরীণ টিকাদান কর্মসূচী নিয়েই ব্যস্ত আছে। তবে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মতো সংকটাপন্ন কোভিড আক্রান্ত দেশে ভ্যাকসিন সাহায্য পাঠানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
যেসব দেশ ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে না, তাদের জন্য উন্মুক্ত আছে বাজার। বাজার ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে কিছু দেশকে ভ্যাকসিন সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবস্থা প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। ২৭ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ইউনিয়ন লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বিতরণ করেছে। ইসরায়েল শুরু থেকেই ভ্যাকসিন কর্মসূচীতে এগিয়ে আছে। নিজেদের শক্তিশালী ফার্মাসিউট্যাল খাত থাকা সত্ত্বেও দেশটি তাদের টিকা কার্যক্রমে নিয়োজিত করার পরিবর্তে লাখ লাখ ডোজ ফাইজার বায়োএনটেজ আমদানি করেছে। এমনকি, দেশটি দ্রুততার সাথে কার্যকরভাবে বিশাল সংখ্যক মানুষকে টিকাদানের আওতায় নিয়ে এসেছে।
কানাডার নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও শীর্ষ ৩৪ বৃহত্তম দেশের মধ্যে টিকাদান হারের দিক থেকে বর্তমানে দেশটি যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় অবস্থানে আছে। কানাডা কয়েক কোটি ভ্যাকসিনের সবই ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে। এমনকি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের মতো দেশও ভ্যাকসিন উৎপাদন না করলেও সফলভাবে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে।
তবে, ভ্যাকসিনের বাজার-ভিত্তিক এই সফলতার পুরোটাই আগে থেকে বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর সাথে যাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক যত দৃঢ়, তারাই তত বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।
এর বাইরে অন্যান্য দেশগুলোতে টিকাদানের হার খুবই সামান্য। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিপুল সংখ্যক অ্যাস্ট্রেজেনেকা ডোজ মজুদ থাকলেও সীমিত সরবরাহের কারণে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া স্বত্বাধিকার আইন এবং অবকাঠামোগত বাধার কারণে গুটিকয়েক দেশের হাতে ভ্যাকসিন উৎপাদনের মাধ্যমে মনোপলি বা একক প্রতিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। বাণিজ্য সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাধান্যের কারণে এর বাইরে কিছু দেশ সফলভাবে টিকা দিতে পারলেও, বাকি বিশ্ব এখনো হাত পেতে বসে আছে।
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে 'কোভ্যাক্স' কর্মসূচী গ্রহণ করে। বিশ্বজুড়ে ন্যায্যভাবে ভ্যাকসিন বিতরণের জন্য ভ্যাকসিন বিষয়ক গবেষণা এবং উৎপাদনের লাইসেন্সের সমন্বয় ঘটাতে উদ্যোগটি গৃহীত হয়। তবে এখন পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা সীমিত পর্যায়েই থেকে গেছে। যৌথ উদ্যোগে মাত্র কিছু সংখ্যক ভ্যাকসিন বিতরণ করা গেছে। পরিবর্তে, অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র ভ্যাকসিন সীমিত সরবরাহ বজায় রেখে ভ্যাকসিন রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
তবে, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, অন্যান্য ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশগুলো তখন বৈশ্বিক চাহিদাকে পুঁজি করে কূটনৈতিক চাল চালতে শুরু করেছে।
চীন এবং রাশিয়া সক্রিয়ভাবে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে জড়িয়ে গেছে। শুধু পররাষ্ট্র নীতিমালা নিয়ে আপসের মাধ্যমে নয়, বরং ভ্যাকসিনের বদলে তারা নিজেদের অনুকূলে ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনেও মনোযোগ দিয়েছে।
রাশিয়ার স্পুটনিক-ভির পিছে আছে ইসরায়েলি অর্থায়ন। ফেব্রুয়ারি মাসে সিরিয়ায় স্পুটনিক-ভি পাঠানোর শর্তে রাশিয়া সিরিয়ায় আটক রাশিয়ান নাগরিকের মুক্তির দাবি তুলে। একই ভাবে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে নিজেদের ভূ-রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে।
চীন ঘোষণা করেছে যে তাদের সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দুটো "বৈশ্বিক জনসাধারণের সম্পদ"। এরই মধ্যে প্রায় ১০০টি দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ শুরু করেছে চীন। অনেক ক্ষেত্রে তারা কোনো মূল্যও রাখছে না। এর মধ্যে কয়েকটি চুক্তি সম্ভবত স্থানীয় কর্মকর্তাদের ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ধারণা করা হচ্ছে যে, যেসব রাষ্ট্র এর আগে ফাইজারের সাথে চুক্তিতে গেছে, তাদের পূর্ববর্তী চুক্তি থেকে সরিয়ে আনতেই বেশ কিছু দেশে টিকা সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে, নতুন করে ফাঁস হওয়া তথ্য অনুসারে, ভ্যাকসিন কূটনীতির মাধ্যমে তাইওয়ানের বিষয়ে প্যারাগুয়ের অবস্থান পুনঃনির্ধারণের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে চীন। এছাড়া, ভ্যাকসিন চালানের পূর্বশর্ত হিসেবে ব্রাজিলের উপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশটির ফাইভ-জির বাজার হুয়াওয়ের জন্য উন্মুক্ত করার মাধ্যমে চীন সাফল্য ধরে রেখেছে।
ভ্যাকসিন নিয়ে চলমান কূটনীতি যদি সুযোগের সদ্ব্যবহার বা এককালীন বিষয়ও হয়ে থাকে, তবুও এই প্রতিযোগিতায় রাশিয়া এবং চীন এগিয়ে থাকবে।
যদি প্রতি বছর ভ্যাকসিন বুস্টার হিসেবে একাধিক ডোজের প্রয়োজন না পড়ে, তাহলে হয়তো বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক পুনর্গঠন সেভাবে পরিলক্ষিত হবে না। তবে, শীর্ষ মহামারি বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা অনুযায়ী যদি প্রতিবছর ভ্যাকসিন গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনাই বেশি।