গঙ্গায় শুধু লাশ আর লাশ
গত কয়েকদিন ধরে সারি সারি লাশে ভরে উঠেছে ভারতের পবিত্রতম নদী গঙ্গা।
বিগত কয়েকদিনে গঙ্গায় শতাধিক লাশ ভাসতে দেখা গেছে। এছাড়া নদীর তীরে বালুতেও পুঁতে ফেলা হয়েছে বহু লাশ। ভারতের উত্তর প্রদেশে ভেসে এসেছে অসংখ্য লাশ। স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা মৃতদেহগুলো কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের লাশ।
কয়েক সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় বিপর্যন্ত ভারত। দেশটিতে রেকর্ডকৃত কোভিড আক্রান্তের শনাক্ত সংখ্যা আড়াই কোটি ছাড়িয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে দুই লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ। তবে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রকৃত সংখ্যা আরও বহুগুণে বেশি।
নদীর ধারে পাওয়া লাশগুলো একত্রে গণদাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতদিন ২৪ ঘন্টা চলে শব পোড়ানোর কাজ। শ্মশানে দেখা দিয়েছে স্থান সংকট। চলমান এই পরিস্থিতি থেকে দাপ্তরিক নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া অসংখ্য মৃত্যুর আভাস মিলছে।
উত্তর প্রদেশের সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে বিবিসি স্থানীয় প্রতিবেদক, কর্মকর্তা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে ভাসতে থাকা এসব লাশের পেছনে প্রচলিত বিশ্বাস, দারিদ্র্য এবং দ্রুতগতিতে মানুষকে মারতে থাকা মহামারির সন্ধান পায়।
নদীর ধারে সারি সারি কবর
উত্তর প্রদেশের ভয়াবহ এই পরিস্থিতি গত ১০ মে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে। সেদিন রাজ্যের সীমানার কাছে বিহারের বক্সার জেলার চৌসা গ্রামে নদীর ধারে ৭১টি লাশ ভেসে আসে।
বক্সারের পুলিশ সুপার নীরজ কুমার সিং বিবিসিকে জানান, সবথেকে বেশি পচন ধরা লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করা হয়। পরবর্তীতে, এসব লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে নদীর ধারে গর্ত খুঁড়ে দাফন করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভেসে আসা লাশের অবশিষ্টাংশের কিছু হয়তো শাস্ত্রবিধি মেনে দাহের পর ভাসিয়ে দেওয়া লাশের অংশ হতে পারে। তবে, তারা ধারণা করছেন যে লাশগুলোকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। নতুন কোনো লাশ আসলে তা আটকাতে পুলিশ নদীর ওপর জাল বিছিয়েছে।
কনৌজ, কানপুর, উন্নাও এবং প্রয়াগজে নদীর ধারে বিন্দু বিন্দু দেখতে অসংখ্য কবরের সন্ধান মিলেছে। মেহেন্দি ঘাট থেকে বিবিসিকে পাঠানো একটি ভিডিওতে কবরের মতো আকারের অসংখ্য উঁচু ঢিবি দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি ঢিবির নিচে লুকানো আছে একেকটি লাশ। মহাদেবী ঘাটে এরকম অন্তত ৫০টি দেহের সন্ধান পাওয়া গেছে।
মৃতের সংখ্যা নিয়ে বড় গরমিল
প্রচলিতভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শবদাহ করে থাকলেও বহু সম্প্রদায় অন্তিম ক্রিয়ার ক্ষেত্রে 'জল প্রবাহ' নামের একটি রীতি অনুসরণ করে থাকে। এই রীতি অনুযায়ী, শিশু, অবিবাহিত মেয়ে এবং সংক্রমণ ব্যাধি বা সাপে কাটার পর কেউ মারা গেলে তাদের দেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
তবে, অনেক দরিদ্র মানুষই চিতার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন না। তারা মৃতদেহ সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে জলে ভাসিয়ে দেয়। কখনো কখনো লাশের সাথে পাথর বেঁধে দেওয়া হয় যাতে সেগুলো ভেসে উঠতে না পারে। তবে ভার ছাড়াও অনেক লাশ ভাসানো হয়ে থাকে। আর তাই সাধারণ সময়েও গঙ্গায় মৃতদেহ ভাসতে দেখা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে, অস্বাভাবিক বিষয়টি মূলত স্বল্প সময়ের মধ্যে শতাশিক লাশের দেখা মেলা। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন স্থানে নদীর ধারে এসব লাশ এসে ভিড়ছে। কানপুরের একজন সাংবাদিক বিবিসিকে বলেন, লাশগুলো মৃতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের গরমিল করার প্রমাণ দিচ্ছে। বিষয়টিকে তিনি "মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত সংখ্যার সাথে দাপ্তরিক নথিপত্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত মৃতের সংখ্যার মধ্যে ব্যাপক অসামঞ্জস্য" হিসেবে চিহ্নিত করেন।
তিনি জানান, আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী, কানপুরে গত ১৬ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত কোভিড ভাইরাসজনিত মৃতের সংখ্যা ১৯৬। কিন্তু, সাতটি শ্মশানের তথ্য অনুসারে একই সময়ে আট হাজার শব দাহ করা হয়েছে।
"এপ্রিল মাসে শব পোড়ানোর সকল ইলেকট্রনিক চুল্লি সপ্তাহে সাত দিন ২৪ ঘন্টা করে চলেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট না হওয়ায় প্রশাসন বাইরের মাঠে কাঠ ব্যবহার করে দাহের অনুমতি দেয়," বলেন তিনি।
সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে দাফন
কোভিড আক্রান্তদের পঁচে যাওয়া লাশ, কবরের সন্ধান পাওয়ার ফলে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে আতঙ্ক বিস্তার করেছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নদী গঙ্গার উৎপত্তি স্থল হিমালয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নদীটিকে পবিত্র বিবেচনা করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে পাপ মোচন সম্ভব। ধর্মীয় বিভিন্ন আচার পালনেও এই নদীর জল ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কনৌজের ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ জগমোহন তিওয়ারি স্থানীয় এক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তিনি নদীর ধারে "দেড়শো থেকে দুইশোটি" কবর দেখেছেন। তিনি বলেন, "সকাল ৭টা থেকে শুরু করে রাত ১১টা পর্যন্ত দাফন চলে। বিষয়টি হৃদয়বিদারক।"
কবরের সন্ধান পাওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে। বৃষ্টি নামলে বা নদীতে পানি বাড়লে পুঁতে ফেলা লাশগুলো পুনরায় ভেসে উঠবে আশঙ্কা করছে সাধারণ মানুষ।
গত বুধবার রাজ্য সরকার 'জল প্রবাহ' নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া দাহের ব্যয়ভার বহন করতে অক্ষম এ ধরনের দরিদ্র পরিবারগুলোকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন স্থানে পুলিশ লাঠির সাহায্যে লাশ তোলার চেষ্টা করছে। অনেক জায়গায় লাশ তুলে আনতে জেলেদের কাজে লাগানো হচ্ছে। পচন ধরা লাশগুলো দাহ নয়তো গর্ত করে মাটিতে সমাহিত করা হচ্ছে।
উত্তর প্রদেশের গাজিপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মঙ্গলা প্রসাদ সিং বিবিসিকে জানান, মানুষ যাতে লাশ পানিতে ফেলা বা পুঁতে রাখা থেকে বিরত থাকে, তা দেখার জন্য কয়েকটি দল ঘাট এবং শ্মশানে টহল দিয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিদিনই নদীতে দুই-একটি লাশের দেখা মিলছে।
"আমরা শাস্ত্র অনুযায়ী তাদের অন্তিম ক্রিয়ার আয়োজন করছি," বলেন তিনি।
- সূত্র-বিবিসি