নওশাবা কি একঘরে?
ছোটবেলায় নিজের আগ্রহেই ছবি আঁকতেন কাজী নওশাবা আহমেদ। গতানুগতি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেননি তিনি। তবে গান ও নাচ শেখার প্রবল আগ্রহ ছিল তার। মাঝেমধ্যে চেষ্টাও করেছেন। সেগুলো সবার অগোচরে।
এতকিছু না করতে পারলেও এইচএসসি পরীক্ষার পর পরিবারকে বুঝিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। সেখানেই মোটামুটি একটা ভিন্ন জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তিনি মনে করেন, তার মতো অনেক 'পাগল'ই চারুকলায় পড়ে, যারা জীবনটাকে নানাভাবে উদযাপন করে।
সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আড্ডার শুরুতেই ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করেন নওশাবা। বলেন, 'আমাদের বাসায় তখন শ্রীদেবী-মাধুরী-সুচিত্রার সিনেমা দেখা হতো। কখনো বড়দের সঙ্গে বসে, আবার কখনো লুকিয়ে দেখতাম। এই আগ্রহের কারণ, আমি তখন অনায়াসে ওই অভিনয়শিল্পীদের নকল করতে পারতাম। তবে এসব চর্চা হতো বাথরুমে। কল ছেড়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের মতো সংলাপ দিতাম, নাচতাম। কিন্তু বাসার কেউ আমার এই প্রতিভার কথা জানত না। ব্যাপারটা আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল।'
"তারপর তো চারুকলায় ভর্তি হলাম। ফাস্ট ইয়ারে থাকতেই পাপেট শো সিসিমপুরের সঙ্গে যুক্ত হই। সিসিমপুরের স্টাইলিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করি। অনেকেই তখন বলা শুরু করে, 'তুমি ক্যামেরার সামনে কাজ করো।' শুরুতে ভয় ছিল। পরিবার কীভাবে নেবে, সেই শঙ্কা ছিল। তবে সবার আগ্রহে অডিশন দিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই।"
'শুরু করলাম ইকরির ভয়েস দেওয়া ও মাঝে মধ্যে সরসারি ক্যামেরায় সামনে হাজির হওয়া। ওই সময়ই ক্যামেরার প্রেমে পড়ে গেলাম,' বলেন এই তিনি।
তারপর ধীরে ধীরে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান নওশাবা। নাটক, বিজ্ঞাপন, এমনকি চলচ্চিত্রেও দেখা যায় তাকে। মাঝে অবশ্য শুটিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। চিকিৎসা নিতে হয়েছে ভারতে। তা-ও দীর্ঘ সময়। অনেকদিন চলাচল করতে হয়েছে হুইল চেয়ারে। পরিবারের সবাই ভেবেছিল, আর বোধহয় অভিনয়ের দিকে ঝুঁকবেন না নওশাবা। ডাক্তাররাও মানা করে দিয়েছিলেন নাচ, গান কিংবা অভিনয় আরও দেরিতে করতে।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! নওশাবার ঠিকই যুক্ত হয়ে যান অমিত আশরাফের 'উধাও' সিনেমায়। সেটা নিয়ে আলোচনা চলতে চলতে যুক্ত হন 'ঢাকা অ্যাটাক' সিনেমায়। এরমধ্যে অবশ্য বিয়ে করেছেন। প্রকৃতি নামে একটা সন্তান এসেছে তার কোলজুড়ে।
বেশিরভাগ ফিকশনে নওশাবাকে দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ ক্যারেক্টার আর্টিস্ট হিসেবে; গতানুগতিক গ্লামারাস নায়িকা হিসেবে নয়। জানতে চাই, এটা ইচ্ছে করেই নাকি সুযোগ আসেনি?
নওশাবা বলেন, 'সত্যি কথা বলতে এসব নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। আমার কাছে চরিত্রটা গুরুত্বপূর্ণ। আর গ্লারামাস নায়িকা হওয়ার জন্য সাপোর্টিং অনেক কিছু লাগে, যা আমার ছিল না কখনোই। আমার কাছে অনেক সময় নায়িকা চরিত্রের অফার করা হলেও পরে বাতিল করে হয়তো পার্শ্বচরিত্রের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু আমার এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই।'
মাঝে নওশাবার ক্যারিয়ারে আরও একটা ধাক্কা গেছে। সেটা তিন বছর আগের সড়ক আন্দোলনের সময়। একটা ফেসবুক লাইভকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের পর দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয় তাকে। আদালতে এখনো মামলা চলছে। তবে অভিনয় বা দেশের বাইরে যেতে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই। চাইলে নিয়মিত অভিনয় করে যেতে পারবেন তিনি।
কিন্তু নিয়মিত কেন, ওই ঘটনাকে ইস্যু করে অনেক কাজ থেকেই বাদ পড়ছেন নওশাবা। অনেক সহকর্মী তার সঙ্গে কাজ করতে চাইছেন না। অনেকটা একঘরে অবস্থায় আছেন। অনেক জায়গায় চূড়ান্ত হওয়ার পরও বাদ পড়ছেন। শুধু তাই নয়, শুটিং করার পরও নওশাবাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়ে পুনরায় শুটিং করা হয়েছে।
এসব নিয়ে অকপটে কথা বলেন নওশাবা, 'দেখুন আমাকে যেটার জন্য দায়ী করা হয়েছে, সেটা আদালতে বিচারাধীন। সেখান থেকেই চূড়ান্ত রায় আসবে। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই, আমার ওপর তো কোনো ট্রাভেল বার বা ওয়ার্ক বার নেই। আমি যেকোনো জায়গায় ভ্রমণ এবং কাজ করতে পারব। তাহলে আমাকে কেন সবকিছু থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে? কিংবা অভিনয় করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে না?'
তিনি আরও বলেন, "নওশাবা কাজ করলে সমস্যা আছে- এরকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছে সবার মাঝে। কিন্তু সত্যি কথা কি জানেন, অনেক কো-আর্টিস্টই এখন আমার কাজের সবচেয়ে বড় বাধা। ডিরেক্টরটা আমাকে চূড়ান্ত করলেই কো-আর্টিস্টরা না করে দেন। তারা ডিরেক্টরকে প্রেসার দেন, 'ও থাকলে কাজ করব না।' যদিও মাঝে মধ্যে ডিরেক্টরের অনুরোধে রাজি হন, তখন আবার চরিত্র নিয়ে আপত্তি তোলেন।"
"এমনও হয়েছে, শুরুতে ডিরেক্টর আমাকে যে চরিত্রের কথা বলেন, শুটিংয়ের আগে সেটা পরিবর্তন করে দেন। মানে চরিত্র আমার, ঠিক করে দেন কো-আর্টিস্টরা। এসব বিষয়ে হয়তো শুরুতে জানা যেত না বা চাপা থাকত; কিন্তু এখন আমার কাছে সব খবর আসে। অনেক সময় ছোট চরিত্রে ভালো করার পরে ডিরেক্টরাই বলেন, 'আপনি এত ভালো অভিনয় করেন, এই কারণে আপনাকে ওই চরিত্রের জন্য নিতে চেয়েছিলাম।' আবার, আমার নাম শুনলে অনেক চ্যানেল থেকে আপত্তি ওঠে। কেন? আমি কি ঠিকঠাক কাজ করে বাঁচতে পারব না?"
বছর খানেক আগে কলকাতায় গিয়ে হৈ চৈ-এর 'একেন বাবু' নামে একটা সিরিজে কাজ করে এসেছিলেন নওশাবা। কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, 'তাহলে কেন আমাকে আটকে দেওয়া হচ্ছে, বলতে পারবেন?'
তিনি থাকলে সিনেমা সেন্সর পাবে না- এমন কথাও শুনতে হয়। এ কারণে ১৮ দিন শুটিং করার পরও তাকে বাদ দিয়ে ওই চরিত্রে আরেকজনকে নিয়ে শুটিং করেছেন এক পরিচালক। এই ঘটনা উল্লেখ করে নওশাবা বলেন, 'কেউ তো কখনো জানতে চায় না, খোঁজ নেয় না। ওই ঘটনার পর আমার দু-তিনটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সেগুলো তো আটকে দেওয়া হয়নি। তাহলে কেন এ ধরনের কথা ছড়ানো হচ্ছে?'
তিনি জীবনের ওই বাজে সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, "আমার খারাপ সময়ে সহকর্মীরা পাশে ছিলেন না বললেই চলে। হাতেগোনা কয়েকজন সাংবাদিক আর থিয়েটার কর্মীরা ছিলেন। তারা এখনো আছেন। সত্যি কথা বলতে, এখনো যা টুকটাক কাজ করি, সেটা কোনো না কোনোভাবে থিয়েটারের কোনো কর্মীর মাধ্যমে আসা। এর কারণ কী জানেন, থিয়েটারে সত্যিকারের শিল্পের চর্চা, শিল্পের বোধ নিয়ে কাজ হয়। শুধুমাত্র অর্থ, যশ, খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা থাকলেই তাকে শিল্পী বলা যাবে না। দুঃখ কি জানেন, একটা সময় যাদের সঙ্গে কাজ করেছি, তারা আমার ফেসবুকের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে না। ফোন করলে শুধু আশ্বাস দেয়। এখন খুব মন খারাপ নিয়ে যখন স্ট্যাটাস দেই, তখনো কোনো সহকর্মী জানতে চান না, 'নওশাবা কি ঠিক আছিস? ভালো আছিস?' অথচ কলকাতা থেকে আমার ফোন আসে বা সাধারণ কোনো ভক্ত হয়তো নক করে জানতে চায়। অথচ যাদের সঙ্গে এতদিন কাজ করলাম, যাদের সহকর্মী ও বন্ধু ভাবলাম, তারা একবারের জন্যও জানতে চান না। একজন শিল্পী হিসেবে এটাই বড় দুঃখ।"