ঘূর্ণিঝড় ইয়াস: দুর্গত সাড়ে ৮ লাখ, ৯ জনের মৃত্যু
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ও বৃষ্টির কারণে দেশের কয়েকটি এলাকায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। অনেক এলাকায় চিংড়ি ঘেরসহ ফসলেরও ক্ষতি হয়েছে।
সরকারি হিসাব বলছে, সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে সারাদেশে ৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো বাতাস ও জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ার কারণে দুর্গত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫৩,০০০।
জেলা প্রশাসকদের পাঠানো প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক জানিয়েছেন, ১৬টি জেলার ৭৭টি উপজেলার ৪৪২টি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার ৮,৫০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১ হাজার ঘরবাড়ি।
আতিকুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এগুলো জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে পাওয়া একেবারেই প্রাথমিক তথ্য। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে"।
"বিভিন্ন ধরণের ত্রাণ সামগ্রী আগেই দেয়া ছিল। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল। ৯টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ১৬,৫০০ প্যাকেট খাদ্য সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। এতে ১৬৫০০ পরিবার এক সপ্তাহ খাবারের চাহিদা মিটাতে পারবে, বলেন তিনি।
এদিকে বিভিন্ন জেলা থেকে মৎস্য ঘের ভেসে যাওয়া, পশুপাখি নিহত ও উপকূলীয় বাঁধ ভাঙ্গার খবর পাওয়া গেছে।
ঘূর্ণিঝড়টি বুধবার (২৬ মে) দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময়ে উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করে। বর্তমানে এটি দুর্বল হয়ে একই গতিপথে উড়িষ্যার উপর নিম্নচাপে রূপ নিয়ে স্থলপথে অতিক্রম করছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও আবহাওয়া অধিদপ্তর বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে। কোন মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলারকে সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৫০-৫৬ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যাওয়া ও স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৪ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি উঠার কথা জানিয়েছে আবহওয়া অধিদফতর।
ইয়াসের কারণে উড়িষ্যায় তিন ও পশ্চিমবঙ্গে এক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ৩ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর দিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম যেখানে দুর্গত মানুষের সংখ্যা বলা হয়েছে ১ কোটি। ১৬ লাখ লোককে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছিল।
সুন্দরবন-খুলনা-সাতক্ষীরা অংশে সবপুকুরই লোনা হয়ে গেছে
সুন্দরবনে পশ্চিম অংশের ৫৪টি পুকুরের মধ্যে ৫৩টি পুকুরে লোনা পানি ঢুকে পড়ার কথা জানিয়েছেন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মোহসীন হোসেন। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সুন্দরবন খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের ৫৪টি পুকুরের মধ্যে ৫৩টি পুকুরেই লবণ পানি প্রবেশ করে পানি পানের অনুপযোগী হয়ে গেছে। লবণ ঢুকে পড়ায় বন্যপ্রাণীদের জন্য পানির সমস্যা হবে।"
১৫টি কাঠের জেটি ও ৮৩টি অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি অফিসের চাল উড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন বন সংরক্ষক (সিএফ-খুলনা সার্কেল) মো. মঈনুদ্দিন খান। এছাড়া হরিণের চারটি মৃতদেহ ও দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি সুন্দরবনকে প্লাবিত করলে এসব ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বাগেরহাট ও বরগুনা অংশে পুকুর লোনা হওয়ার সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাতক্ষীরায় মৎস্য ঘের ডুবে ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ কোটি টাকা
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর, গাবুরা, কৈখালী, নুরনগর ও বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে ৯৫০ হেক্টর জমির দুই হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। টাকার হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আশাশুনি সদর, বড়দল ও খাজরা ইউনিয়নের ১৪৫০ হেক্টর জমির দুই হাজার ৫৬০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, ৪,৫৬০টি মাছের ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪ কোটি ২৩ লাখ টাকার। ঘেরগুলোতে বিক্রির উপযোগী মাছ থাকায় আম্পানের থেকেও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে শ্যামনগরে। জেলায় প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ১৫-২০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
নোয়াখালীতে পানিবন্দী ২০ গ্রামের মানুষ
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অন্তত ২০টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। সুখচর ইউনিয়নে জোয়ারের পানিতে ভেসে যাওয়া লিমা আক্তার নামের ৭ বছরের এক শিশুকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উপজেলার নিঝুমদ্বীপের বন থেকে অন্তত ৪ হাজার হরিণ বনের পাশের উঁচু জায়গা ও লোকালয়ে চলে এসেছে। ইয়াসের প্রভাবে বৃহস্পতিবার দুপুরে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানি আসায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন।
বাগেরহাটে পানিবন্দী ৩ হাজার পরিবার, ২০০০ মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত
নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাগেরহাটের অন্তত ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে। মোড়লগঞ্জ উপজেলার ২,০০০ এর বেশি মৎস্য ঘের ভেসে গেছে।
মোরেলগঞ্জ উপজেলার কেয়ার বাজার থেকে সন্ন্যাসী বাজারে যাওয়ার পিচঢালা রাস্তা দুই জায়গায় ভেঙ্গে গিয়ে যান চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
শুক্রবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির সম্ভাবনা
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের অধিকাংশ স্থানে হালকা থেকে মাঝারি এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায়সহ দেশের পশ্চিম অংশে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ ও বজ্রপাত হতে পারে।
সারাদেশের তাপমাত্রা একই থাকবে। তাপদাহের বার্তা তুলে নিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।