বয়স্ক, বিধবা ও অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ২৩ বছর আগে মাসে ১০০ টাকা ভাতা নির্ধারণ করে বয়স্ক ভাতা চালু করে সরকার, যা এখন বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে। পরের বছর থেকে চালু করা বিধবা ভাতার পরিমাণও একই সমান। তার দু'বছর পর ৩০০ টাকা হারে সম্মানী ভাতা চালু হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যা বেড়ে হয়েছে ১২০০০ টাকা।
অর্থাৎ, চালুর পর থেকে প্রায় দুই দশকে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা বেড়েছে ৪০০%, একই সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা বেড়েছে ৩৯০০%।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী বাড়িয়ে ২০,০০০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হবে বলে জানিয়েছেন বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বয়স্ক, বিধবা ও অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোরও প্রস্তাব থাকছে এতে। তবে এসব উপকারভোগীর মাসিক ভাতার পরিমাণ বাড়ছে না বলে জানান তারা।
আগামী অর্থবছর ১৫০টি উপজেলার সকল বয়স্ক ও বিধবা এবং নতুন করে প্রায় চার লাখ অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীকে ভাতার আওতায় আনা হচ্ছে।
বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়ানো, আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে তাদের মনোবল জোরদার করা এবং তাদের চিকিৎসা ও পুষ্টি সরবরাহ বাড়াতে সহায়তার অংশ হিসেবে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো মাসে ১০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতা চালু করে সরকার। একই উদ্দেশ্যে পরের বছর বিধবা ভাতা চালু করে সরকার।
চালুর আট বছরের মাথায় তা দ্বিগুণ করে তিন বছর পর তা ৩০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। গত তিন বছর ধরে উপকারভোগীরা মাসে ৫০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে বয়স্ক ও বিধবা ভাতাভোগীদের সুবিধা তেমন বাড়েনি। দু'দশক আগে ১০০ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা ভোগ করা যেতো, এখন একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা ভোগ করতে ৩৮৫ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ফলে মাসিক ৫০০ টাকা ভাতা দরিদ্র, বয়স্ক ও বিধবাদের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে কিছুটা ভূমিকা রাখলেও যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসব ভাতা চালু করা হয়েছিল, তা পূরণ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নিম্ন দারিদ্র্য রেখা সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে একজন ব্যক্তির প্রতি মাসে গড়ে ১,৮৬২ টাকার প্রয়োজন হয়।
মূল্যস্ফীতির কারণে এখন এই পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার টাকা। অর্থনীতিবিদের মতে একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কেবলমাত্র ৫০০ টাকাই যথেষ্ট নয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা চালু করে সরকার। শুরুতে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়। চালুর পাঁচ বছর পর ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়।
পরের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে এ ভাতা বেড়ে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মাসে ৫০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তার তিন বছর পর এটি বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয় এবং গত অর্থবছর তা ১২,০০০ টাকা করা হয়েছে।
২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের নগদ ভাতার আওতায় আনে সরকার। শুরুতে তাদের মাসে ২০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হতো, যা এখন বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে।
এর এক বছর পর মাসে ৩০০ টাকা হারে ভাতা নির্ধারণ করে দরিদ্র মা'দের মাতৃত্বকালীন ভাতা চালু করে সরকার, এখন এ মায়েরা মাসে ৮০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। আর ১০ বছর আগে কর্মজীবী ও ল্যাকটেটিং মাদারদের জন্য মাসে ৩৫০ টাকা ভাতা চালু করা হয়, এখন এর পরিমাণ ৮০০ টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব ভাতা অপরিবর্তিত থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
চলতি অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ৯৫,৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, এর মধ্যে প্রকৃত দরিদ্রদের সরাসরি সহায়তায় বরাদ্দের পরিমাণ খুবই কম। চলতি অর্থবছর বয়স্ক ও বিধবা ভাতা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, দরিদ্র মা'দের মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং কর্মজীবী ও ল্যাকটেটিং মাদার আওতায় রয়েছেন ৯৭.৯৫ লাখ, যাদের ভাতায় বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৬২২৭.৫৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৬.৫ শতাংশ।
মাসিক সম্মানী ভাতা ও উৎসব ভাতার পাশাপাশি ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ২০০০ টাকা করে বাংলা নববর্ষ ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, সকল জীবিত মুক্তিযোদ্ধা বিজয় দিবসে ৫০০০ টাকা করে সম্মানী পেয়ে থাকেন।
সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা হিসেবে বরাদ্দ রয়েছে ৩৩৮৫.০৫ কোটি টাকা, যা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীখাতে মোট বরাদ্দের ৩.৫৪ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা নির্ধারণে সরকার উদারতার পরিচয় দিয়েছে। এতে কারও কোন আপত্তিও নেই। তবে এক জায়গায় ভাতার পরিমাণ ১২,০০০ টাকা, অন্য জায়গায় ৫০০ টাকা- এটা বেমানান'।
তিনি বলেন, 'ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দিন দিন কমার কথা থাকলেও তা কমছে না, বরং বাড়ছে। ২০০১-০২ অর্থবছর যখন এ ভাতা চালু হলো, তখন ভাতা পেতেন ৪২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত এ সংখ্যা দুই লাখে স্থির রয়েছে। অথচ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, মুক্তিযোদ্ধারা কি মারা যান না'?
'এই ভাতা পাওয়ার জন্য, চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য অনেকে বিভিন্ন কায়দায় মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। সরকারের উচিত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করে তাদের সুবিধা বাতিল করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্যান্য খাতের সুবিধাভোগীদের মাঝে তা বন্টন করা', যোগ করেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে বয়স্ক ও বিধবারা মাসে যে ভাতা পান, তা দিয়ে একজন দরিদ্র মানুষ ৫ দিন খেতে পারেন। তাদের ভাতার পরিমাণ আরও বাড়ানোর পাশাপাশি পরিধিও বাড়ানো প্রয়োজন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সচিব ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভাতা দেয়, সেটা সম্মানী। তাই তাদের ভাতার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুবিধাভোগী অন্যদের ভাতার তুলনা চলে না। তবে সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বয়স্ক ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে আরও অর্থবহ করা প্রয়োজন'।
'সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ভাতা বাড়ানোর সামর্থ্য সরকারের রয়েছে। সরকারি ব্যয়ে অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে খুব সহজেই তা সম্ভব হবে। এছাড়া, বিদ্যমান ব্যবস্থায় উপকারভোগী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে 'ইউনিভার্সাল পেনশনে' রূপান্তর করা প্রয়োজন। সরকার তার সামর্থ্য অনুযায়ী এখন এটি শুরু করতে পারে, পরে পর্যায়ক্রমে এর আওতা বাড়ানো যেতে পারে', যোগ করেন তিনি।