কঠোর পরিশ্রম, আর ধৈর্য্যে দুগ্ধখামার করে স্বাবলম্বী পাবনার অসংখ্য যুবক
ছাত্রজীবন থেকে স্বপ্ন ছিল একটি দুগ্ধ খামার করার। স্বপ্ন পূরণের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সব বাধাই ডিঙিয়েছেন পাবনার মামুন হোসেন। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য্য আর একাগ্রতায় তার সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। সুজানগর উপজেলার ঘোড়াদহ গ্রামের মরহুম আব্দুস শুকুর মোল্লার ছেলে মামুন দুগ্ধ খামার করে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন এলাকার বহু বেকার যুবকের। স্বল্প পরিসরে শুরু করা এ খামার কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতায় মাত্র কয়েক বছরে পরিণত হয়েছে এক বিশাল প্রকল্পে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে খামার পরিচালনা করে তিনি অন্যদের কাছে হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয়।
২০১২ সালে তিনি ৪টি উন্নত জাতের গাভী কিনে নিজ বাড়িতে দুগ্ধ খামার শুরু করেন। প্রায় দুই লক্ষ টাকা দিয়ে ৪টি গাভী কিনে শুরু করা ওই খামারে এখন গাভীর সংখ্যা ২০টি। মাত্র ৪টি গাভী দিয়ে শুরু করা ওই খামার আস্তে আস্তে এখন উপজেলার মধ্যে সব চেয়ে বড় খামারে পরিণত হয়েছে।
খামারী মামুন জানান, বর্তমানে তার খামারে প্রতিদিন প্রায় ৩'শ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এ সব দুধ ব্র্যাক এবং আড়ং কোম্পানির পাশাপাশি স্থানীয় হোটেল-রেঁস্তোরায় বিক্রি করা হয়। প্রতিমাসে দুধ বিক্রি করে শ্রমিক ও খাদ্যসহ অন্যান্য খরচ বাদে তার প্রায় তিন লক্ষ টাকা আয় হয় বলে তিনি জানান।
মাত্র ৩৮ বছর বয়সী ওই যুবক মামুন দুগ্ধ খামার করে শুধু নিজেই স্বাবলম্বী হননি, এলাকার অনেক বেকার মানুষেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে খামারে ৯জন শ্রমিক চাকরি করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন । মামুনের সাফল্য দেখে একই এলাকার বেকার যুবকদের অনেকেই দুগ্ধ খামার করার দিকে ঝুঁকছেন।
সফল খামারী মামুন বলেন,যে কোনো কাজে সফলতার জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য্য। এ পর্যন্ত আসতে তার বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। তবে তিনি ধৈর্য্য হারাননি। আর সেকারণেই আজ তার এই সফলতা।
শুধু মামুনই না, মামুনের মত দুগ্ধ খামার করে ভাগ্য খুলেছে পাবনার অসংখ্য বেকার যুবকের। পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, সুজানগর উপজেলাসহ জেলার অধিকাংশ এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য দুগ্ধ খামার। ফলে বর্তমানে জেলাটি পরিণত হয়েছে দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা।
তবে চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ফলে এই অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক এই খাতের সাথে জড়িতদের মধ্যে চরম উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও দুধের সরবরাহ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি দুগ্ধ খামারিদের।
প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী এ এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ২০ হাজার দুগ্ধ খামার রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়। সব মিলিয়ে এ এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদন করা হয়। এ এলাকার গরুর দুধের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে সরকারি মিল্ক ভিটা এবং বেসরকারি প্রাণ ডেইরি, আড়ং দুধ, ফার্ম ফ্রেস, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরিসহ বেশ কিছু দুগ্ধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে থাকে। বাকি দুধ স্থানীয় বাজার ছাড়াও জেলার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানসহ স্থানীয় ছানা প্রস্তুতকারীদের কাছে বিক্রি করা হয়।
দুধ থেকে স্থানীয় ছানা প্রস্তুতকারীরা ছানা তৈরির জন্য প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক লিটার দুধ সংগ্রহ করে থাকেন। বর্তমানে পাবনায় ১০০টির অধিক ছানা তৈরির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এক হাজারেরও বেশি মানুষের। ওই সব কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মণ ছানা তৈরি করা হয়ে থাকে।
ছানা তৈরির কারিগরেরা জানান, এক মণ দুধে ৮ কেজি ছানা পাওয়া যায়। কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ছানার মধ্য থেকে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ মণ ছানা স্থানীয় মিষ্টির দোকানগুলোতে সরবরাহ করা হয়। দেশব্যাপী চাহিদা থাকায় বাকি প্রায় ৩৫০ মণের মতো ছানা ঢাকা, চট্রগ্রাম, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতি কেজি ছানা এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
পাবনার সাঁথিয়ার উপজেলার সেলন্দাহ গ্রামের ছানা প্রস্তুতকারী নিমাই ঘোষের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, তিনটি চুল্লিতে বড় ধরনের পাত্রে দুধ ফুটানো হচ্ছে। এক পর্যায়ে ফুটানো দুধ থেকে তৈরি হচ্ছে ছানা। ছানা তৈরির পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে বিশেষ কায়দায় পানি ঝড়িয়ে তা ঢাকায় পাঠানোর উপযোগী করে বস্তাভর্তি করা হচ্ছে।
ছানা কারখানার মালিক নিমাই ঘোষ জানান, তার কারখানায় ১২ জন ছানা তৈরির কাজ করে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে ২৫ মণের মতো ছানা তৈরি হয়। তার কারখানায় উৎপাদিত সব ছানাই উৎকৃষ্ট মানের দাবি করে তিনি জানান উৎপাদনের পর পরই এসব ছানা পিকআপ ভ্যানে ঢাকায় পাঠানো হয়। তবে করোনাকালে পরিবহন সংকট ও সারাদেশেই হোটেল রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
ফরিদপুর উপজেলার দুধ উৎপাদন সমবায় সমিতির সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, তার সমিতি থেকে বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটাতে ৪০ থেকে ৪৫ মণ দুধ সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও তাদের সমিতির ৩০ থেকে ৪০ জন খামারী স্থানীয় বাজারে প্রায় একই পরিমাণ দুধ বিক্রি করে থাকেন। তবে লকডাউনের কারনে স্থানীয় বাজারে ক্রেতার সল্পতা রয়েছে। লকডাউন অব্যাহত থাকলে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ ছাড়াও স্থানীয় বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রেও আরও জটিলতা তৈরি হবে। যা খামারীদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ। এছাড়া গরুর খাবারের দাম বাড়ার কারণে দুধের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
ভাঙ্গুরা এলাকার দুগ্ধ খামারি আব্দুল জলিল বলেন, খামারিরা মিষ্টির দোকান ও ছানা প্রস্তুতকারীদের কাছে বাকীতে দুধ বিক্রি করতে চাইলেও ব্যবসা মন্দার অজুহাতে তারাও এখন আর দুধ নিতে চাইছেন না। এ অবস্থায় বিপাকে পড়ে দুধ থেকে ক্রিম সংগ্রহ করে ঘি প্রস্তুতকারীদের কাছে বিক্রি করছেন তারা। এতে তাদের উৎপাদিত এই বিপুল পরিমান দুধের সামান্য অংশ সঠিক ব্যবহার সম্ভব হলেও নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমান দুধ। এদিকে দুধ বিক্রি বন্ধ থাকলেও খামার পরিচালনায় খরচ করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ অবস্থায় আর্থিক সংকটে পড়েছে দেশের বৃহত্তম এ অঞ্চলের দুগ্ধ শিল্প। সংকট মোকাবেলায় সরকারি ভর্তুকির পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের দাবি জানান খামারিরা।
এমন পরিস্থিতিতে পাবনা প্রানিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আল মামুন হোসেন চলমান সংকটকে বৈশ্বিক সংকট উল্লেখ করে খামারিদের দুধ সংরক্ষণের জন্য বিকল্প পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন । কিন্তু কীভাবে বিপুল পরিমান উৎপাদিত দুধ বিকল্প পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যাবে তার সঠিক সমাধান দিতে পারছেন না তারা।
খামারীদের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন পাবনার জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদ। তিনি বলেন, শুধু দুগ্ধ খামারী না করোনা মহামারির কারণে সকল ক্ষেত্রেই কিছু সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে আছে।
এরই মধ্যে পাবনায় ক্ষতিগ্রস্থ খামারীদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্থদের সব ধরনের সাহায্য দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।