আর নয় আশ্বাসের অপেক্ষা, গ্রামবাসী নিজেরাই নির্মাণ করছেন ১৯০ ফুট সেতু
বছরের পর বছর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে ঘুরেও চলাচলের জন্য নদীর উপর সেতু নির্মাণ করাতে না পেরে নিজেরাই প্রায় দুইশ ফুট লম্বা সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছে গ্রামবাসী। গ্রামের সবাই যার যা সাধ্য তা একত্রিত করে দিচ্ছে অর্থের যোগান। নেই কোন ইঞ্জিনিয়ার বা ভারী যন্ত্রপাতি। দা, কোদাল, কুড়ালই নির্মাণকারীদের হাতিয়ার। এমনটা ঘটেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায়।
সুরিয়া নদী। একপাশে ময়মনসিংহের গৌরিপুর উপজেলার মাউহা ইউনিয়নের নয়া নগর বাউসালি পারা। আরেক পশে নেত্রকোনা সদর উপজেলার দক্ষিণ বিশুরা ইউনিয়নের দুগিয়া এলাকা। এখানে পারাপারের জন্য নেই কোন সেতু। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে পার হইলেও বর্ষায় ভরে যায় নদী। হাজারো মানুষ চলাচলে পড়েন দুর্ভোগে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় চলছে নদীর উপর সেতু নির্মাণ কাজ। দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ- এই প্রবাদ বাক্যটি যেন দৃশ্যমান এখানে। প্রায় ২৫০ ফিট প্রশস্ত নদী। মূল সেতু হবে ১৯০ ফিট,বাকি দুই অংশতে থাকবে সংযোগ সড়ক। বাঁশ,কাঠ, পিলার ও স্টিল ব্যবহার করে সেতু নির্মাণে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৭ লাখ টাকা। গ্রামবাসী কেন নিজের কাঁধে তুলে নিলো, এই সেতু নির্মাণ কাজ ? এমন প্রশ্নের জবাবে উদ্যোক্তাদের একজন কলেজ পড়ুয়া আজাহারুল করিম বলেন, 'এখানে নদী পারাপারের কোন সেতু নেই। শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়া গেলেও বর্ষাকালে পানিতে ছোট ছোট নৌকাই ভরসা। যার ফলে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নারী-শিশু ও শিক্ষার্থীসহ হাজারো মানুষকে। দিনের পর দিন শুধু আশ্বাসই পেয়েছি আমরা। আশ্বাসে আর বিশ্বাস নেই। তাই নিজেদের চলার পথটি সহজ করতে, কারো আশায় বসে না থেকে দা, কোদাল, কুড়াল নিয়ে নিজেরাই সেতু নির্মাণে নেমেছে গ্রামবাসী'।
প্রায় দুইশ ফুট প্রশস্ত নদীর উপর এই সেতু নির্মাণের অর্থের যোগান কিভাবে হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে আজহার উদ্দিন নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, 'এই ব্রিজটি নির্মাণের জন্য গ্রামের মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। যে যার সাধ্যমতো অর্থ দিয়েছে। অনেকে নিজের ঝাড় থেকে বাঁশ দিয়েছেন। অনেকে ধান দিয়েছেন তা বিক্রি করে টাকার যোগান হয়েছে। একইসাথে আশেপাশে যে বাজারগুলো আছে সেই বাজারের দোকানদাররাও তাদের ইচ্ছামতো টাকা আমাদের দিচ্ছেন। সেই টাকাগুলো দিয়েই আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। আর যাদের দেয়ার সামর্থ নেই তারা অনেকে বিনামূল্যে শ্রম দিচ্ছেন'।
স্থানীয় বাউসালি বাজারের ব্যবসায়ী মো: শাহাবদ্দিন বলেন, 'সেতুটি হয়ে গেলে বাজারে লোক সমাগম বাড়বে। সাথে মালামাল পরিবহন সহজ হওয়ায় বাড়বে ব্যবসাও। তাই সেতু নির্মাণে সহায়তা করছে ব্যবসায়ীরাও'।
সেতু যেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে লাল মিয়া নামে একজন কৃষকের আবাদের জমি পড়েছে। তিনি ১৪ শতাংশ জমি বিনামূল্যে দান করেছেন। কৃষক লাল মিয়া বলেন, 'নদীর পাশের জমিতে ধানের ফলন হয় ভালো। যখন দেখলাম সেতু হলে এই এলাকার মানুষের উপকার হবে তখন আর না করতে পারিনি জমি দিয়ে দিলাম। এখন বর্ষা আসার আগে ঠিকঠাক মতো কাজ শেষ হলেই হয়'।
সেতু নির্মাণে গ্রামবাসীকে একত্রিত করার কাজে অংশ নেয়া নেত্রকোনা জেলার হাজী ফয়েজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্জুরুল হক বলেন, 'আমরা কয়েকটি গ্রামের মানুষরা একত্রিত হয়ে এই কাজটি চালিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে নদের দুই পাশে মাটি ভরাট করা হয়েছে। কোদাল দিয়ে মাটি কাটা ও ভরাট করছি আমরা নিজেরাই। এখানে কোন ইঞ্জিনিয়ার বা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কেউ নেই। আমরা নিজেরাই যতটুকু বুঝি করার চেষ্টা করছি, বাদবাকি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি'।
আবু তাহের নামে স্থানীয় এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, 'দেশ স্বাধীন করেছিলাম যাতে আমরা আমাদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারি। এমন দিন দেখতে হবে কোনদিন ভাবিনি। গ্রামের যুবকরা এটা করছে, আমরা বয়স্করা তাদের সাথে আছি। তাদের উৎসাহ পরামর্শ দিচ্ছি। এতে নদীর এই অংশে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ হবে'।
ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সদস্য এইচ এম খাইরুল বাসার বলেন, 'আমার বাড়ি গৌরিপুর উপজেলায়। নিজ এলাকার মানুষের কষ্ট লাঘবে সরকারীভাবে এই সেতু নির্মাণের চেষ্টা তদবির করেছি। কাজ হয়নি কিছুই। তাই গ্রামবাসীকে একত্রিত করে উদ্যোগ নিয়েছি। কারণ আমাদের সমস্যা সমাধানে যদি কেউ এগিয়ে না আসে তখন কারো দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদেরই উদ্যোগ নেয়া ছাড়া কোন রাস্তা থাকে না। এলাকাটি দীর্ঘদিনের একটি অবহেলিত অঞ্চল। এখানে একটি সেতু না থাকায় কয়েকটি এলাকার মানুষের অনেক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আর এখান থেকে ময়মনসিংহ সদর প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে, সুতরাং কেউ অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে সদরে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এখান থেকে আধঘন্টা সময় দূরত্বে নেত্রকোনা সদর হাসপাতাল। তাই এই সেতুটি হয়ে গেলে দুই জেলার যোগাযোগ খুবই সহজ হয়ে যাবে। এসব নানান সুবিধার কথা ভেবে প্রথমে যুবকদের একত্রিত করেছি, তারপর গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছি। তবে আমরা অর্থ সংকটে পড়ব সামনে, সেই সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করছি। আমাদের স্বপ্নের সেতু নির্মাণ হবে এবার এই বিশ্বাস নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি'।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, দিনের পর দিন শুধু বিভিন্ন মহলের আশ্বাসই পেয়ে গেছেন তারা, কাজের কাজ হয়নি কিছুই। কেন সেতু নির্মাণে এগিয়ে আসেনি স্থানীয় প্রশাসন এমন প্রশ্নের জবাবে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান মারুফ জানান, 'গ্রামবাসী নিজেরা একটি সেতু তৈরি করছে এটি আমি ফেসবুক দেখে জেনেছি। গ্রামের মানুষের অভিয়োগের বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো। সেতু নির্মাণে উপজেলা প্রশাসন যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবে। ইতিমধ্যে আমি উপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেছি'।