কাঁচামালের চড়া মূল্যে সংকটে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ শিল্প
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামাল পলিমার, ইয়ার্ন, ক্রাফট পেপার ও কেমিকেলের দাম বাড়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়লেও এর সুফল ভোগ করতে পারছে না ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে গড়ে উঠা তৈরি পোশাক খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম বা গার্মেন্টস এক্সেসরিজ শিল্পগুলো।
করোনার প্রভাব কাটিয়ে গত মার্চ থেকে ভারত ও চীনের শিল্পকারখানাগুলো পুরোদমে উৎপাদন শুরু করায় আন্তর্জাতিক বাজারে এসব কাঁচামালের দাম ৪০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের দাম কমায় এসব এক্সেসরিজের ক্রেতা গার্মেন্ট রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে বাড়তি দাম পাচ্ছেন না। এতে লোকসানে পড়ছেন তারা।
এসএএমএস প্যাকেজিং এর মালিক একেএম মোস্তফা সেলিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্যাকেজিংয়ের জন্য যে কাগজ আগে টনপ্রতি ৮৮০ ডলারে আমদানি করতাম, এখন তার দাম ১৪০০ ডলার। কিন্তু তৈরি পোশাক মালিকরা প্যাকেজিংয়ের দাম বাড়াচ্ছেন না। তাই লোকসান কমাতে বাধ্য হয়ে আগের তুলনায় কম উৎপাদন করতে হচ্ছে'।
'আমাদের মূলধনও খুব বেশি না। এতোদিন পুরো মূলধন দিয়ে ১০০ টন কাঁচামাল আমদানি করতে পারতাম, এখন পারছি ৫০ টনের মতো। ব্যাংকও আমাদের বাড়তি ঋণ দিচ্ছে না। তাই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ধরে রাখতে কোনরকমে কারখানা চালু রাখছি'- জানান তিনি।
দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের বোতাম, হ্যাঙ্গার, কার্টন, জিপার, পলিব্যাগ, সেলাই সুতা, বিভিন্ন ধরনের লেভেল ও হ্যান্ডটেকসহ প্রায় ৪০ ধরণের এক্সেসরিজের যোগান আসে এ খাত থেকে। প্রায় ১৮০০ কারখানা এসব উৎপাদন করে, যাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিক প্রায় ৬ লাখ।
গতবছর মার্চে করোনা ভাইরাসের শুরুতে পোশাক রপ্তানিতে বিপর্যয় নামলে এ খাতের কারখানাগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। সরকার ঘোষিত প্রণোদনায় পোশাকখাত উৎপাদন ও রপ্তানিতে ফিরে আসলে সচল হয় ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজও। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ফিরলেও কাঁচামালের দাম বাড়ায় এক্সেসরিজ খাত এর সুফল পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইয়ুথ লিডার্স অ্যাসোসিয়েশন বা 'বায়লা' এর সাধারণ সম্পাদক আল শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, গত জানুয়ারি থেকে কাঁচামালের দাম বাড়তে শুরু করে। গত পাঁচ মাসে সুতার কেজি দুই ডলার থেকে সাড়ে তিন ডলার। পলিব্যাগ ও হ্যাঙ্গারসহ প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কাঁচামাল পলিমারের প্রতি টনের দাম ৯৬০ ডলার থেকে ১৬০০ ডলার হয়েছে। কার্টন ও বক্স তৈরির কাগজের দামও ৮৮০ ডলার থেকে ১৪০০ ডলারে উঠেছে। প্রতি কেজি কালি ৭ ডলার থেকে বেড়ে ৯-১২ ডলার এবং কেমিকেলের দাম প্রতি কেজি ৫৫ ডলার থেকে ৯০ ডলার হয়েছে।
'কাঁচামালের দাম বাড়লেও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা এক্সেসরিজের বাড়তি মূল্য দিচ্ছেন না। আগের দামেই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। এভাবে আমরা কতোদিন টিকতে পারবো?'- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানগুলো এসএমই ক্যাটাগরিতে হলেও সরকার ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বেশিরভাগ কারখানাই ঋণ পায়নি বলে অভিযোগ করে এ খাতের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)।
সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল কাদের খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শুধু কাঁচামালের দামই বাড়েনি, ফ্রেইট কস্টও বেড়েছে। কিন্তু আমরা এক্সেসরিজের মূল্য পাচ্ছি আগের মতোই। তাই কারখানাগুলো লোকসান করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে'।
'করোনার শুরুতে যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল তা আমরা পাই নি। ওখানে বলা হয়েছে এসএমইখাত ও অপ্রত্যক্ষ রপ্তানিকারকরা ২০ হাজার কোটি টাকা পাবে। ব্যাংকগুলো আমাদের সহযোগিতা করেনি'।
'গার্মেন্ট রপ্তানিকারকদের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, আমরাও যেন তা পাই। আমরাও চার শতাংশ সুদে ঋণ পেতে পারি'। এক্সেসরিজ খাতের জন্যও রপ্তানির বিপরীতে ১ শতাংশ নগদ সহায়তা ও ১২ শতাংশ করপোরেট কর হারের সুবিধা চান তিনি।
'রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের যেন প্রণোদনা দেয়া হয়। কর্পোরেট কর যেন ১২ শতাংশ করা হয়। এক শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হয়। তাহলে সাময়িক অসুবিধা দূর হবে।'
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বিজিএমইএর বরাত দিয়ে বিজিএপিএমইএ জানায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৪০ বিলিয়ন ডলার তৈরী পোশাক রপ্তানির মধ্যে এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্যের মূল্য ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছর পোশাক রপ্তানিতে ব্যয় হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের অংশের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলার।
দেশের ৮৬ শতাংশ রপ্তানি আয়ের উৎস তৈরি পোশাক শিল্পে যে পরিমাণ এক্সেসরিজ দরকার হয়, তার ৯৫ শতাংশই যোগান দেয় এই খাত, টাকার অংকে যার মূল্য ৭ বিলিয়ন ডলার। পূর্ণ সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারলে এটি আরও ১০% শতাংশ বাড়বে।
কাঁচামালের ঊর্ধ্বমূল্যে ক্রমাগত লোকসান হলে এ খাতের অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্প মালিকরা।
তারা বলছেন, করোনার সময় চীনসহ বিশ্বজুড়ে যখন আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ছিল, শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ থাকায় তখনও দেশীয় উৎস থেকে এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং আইটেমের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পেয়েছে গার্মেন্টস সেক্টর।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সংকুচিত হলে বিপুল পরিমাণ এক্সেসরিজের জন্য প্রধান রপ্তানি খাতটিকে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে। তাতে বাড়তি ব্যয়ের পাশাপাশি লিড টাইমও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে পোশাক রপ্তানির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পের পাশাপাশি এক্সেসরিজ কারখানাও রয়েছে তৈরি পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, উপযুক্ত মূল্য পেতে এক্সেসরিজ শিল্প মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে শক্ত ভূমিকা নেওয়া উচিত। কারখানাগুলো যদি একে অন্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রির প্রতিযোগিতা করে, তাহলে ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়া স্বাভাবিক।
'আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক বা এক্সেসরিজের দাম যে হারে বাড়বে, দেশের এক্সেসরিজ উৎপাদকদেরও সে হারে বাড়তি মূল্য পাওয়া উচিত। তবে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের মূল্য কমে গেছে, তাই রপ্তানিকারকরা এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং খাতে বাড়তি ব্যয় করতে আগ্রহী নয়', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) এর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, 'পাঁচ বছরে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৩০ শতাংশ, কিন্তু বায়াররা মূল্য কমিয়েছে দুই শতাংশের মতো। আমরা কিভাবে প্যাকেজিং এবং এক্সেসরিজ কেনায় দাম বাড়িয়ে দিব! আমরাতো নিজেরাই কম পাচ্ছি। আমরা এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিংয়ের দাম কমিয়ে দেইনি। বায়াররা তৈরি পোশাকের দাম না বাড়ালে আমরাও দাম বাড়াতে পারবো না'।