লোভ যখন পতন ডেকে আনে
এক বছরেরও কম সময়ে লগ্নিকৃত অর্থ দ্বিগুণ করার সুযোগ, কিংবা কোনো পণ্যে চোখধাঁধানো ছাড়ের প্রস্তাব পেলে আমরা অনেকেই হয়তো তা লুফে নেব। ঝুঁকির মাত্রা বিচার করতে যাব না। মনের যৌক্তিক অংশ যখন লোভের কাছের হেরে যায়, তখন এমনটি ঘটে।
আমাদের এমন মানসিক পরাজয় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় একদল ব্যবসায়ীর জন্য। আমাদের এ ধরনের আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্তের ফায়দা নিয়ে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়ে নেয় তারা। পকেটে পুরে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা।
কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে এ ধরনের ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। বড় ধরনের বিপর্যয়ের পরই কেবল নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে সক্রিয় হয়—কিন্তু প্রতারিত ক্রেতাদের কোনো প্রতিকার দিতে পারে না।
এমন ঘটনা বর্তমানে অহরহ দেখা যায়। এমনকি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মতো উদাহরণও আছে।
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ইউনিপেটুইউ-এর ঘটনাটাই ধরা যাক। কোম্পানিটি ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের এখানে বিনিয়োগ করলে মাত্র ১০ মাসে দ্বিগুণ টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। হাজার হাজার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে লোভনীয় সুযোগটা লুফে নেওয়ার জন্য। মাত্র ১৩ মাসে প্রায় ছয় লাখ লগ্নিকারীর কাছ থেকে ৬,০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে ইউনিপেটুইউ।
তারপর কী ঘটল? ইউনিপেটুইউ-এর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড দুর্নীতি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের মনোযোগ কাড়তে আরম্ভ করল। এর জেরে ২০১১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মামলা করে। আদালত বিনিয়োগকারীদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু ৩০ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিজেদের টাকা ফিরে পাননি বিনিয়োগকারীরা। প্রতারিত লগ্নিকারীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, কিন্তু কোনো আশ্বাস পাচ্ছেন না।
আরেক এমএলএম কোম্পানি ডেস্টিনির কথাও না বললেই নয়। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি পরের এক দশকে মোটা লাভের টোপ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। নিয়ন্ত্রক বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি বা পদক্ষেপের অভাবে সংগঠনটি প্রকাশ্যে, বিনা বাধায় দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত সন্দেহজনক এই ব্যবসা চালিয়ে গেছে।
২০১২ সালে ডেস্টিনির নানা অনিয়মের তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। অভিযোগ আনা হয় যে, কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে।
একই বছর অভিযোগগুলোর তদন্ত করার পর দুদক দুটি মামলা করে।
সে বছরের ২৭ নভেম্বর, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ডেস্টিনি গ্রুপের সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। সব সম্পত্তি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশকে।
সেই থেকে ডেস্টিনির ঢাকার সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীর বাইরে কোম্পানিটির সম্পত্তি তত্ত্বাবধানে আছেন জেলা পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টরা।
কিন্তু প্রতারিত বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য বদলায়নি। ডেস্টিনি লিমিটেড-এ ৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ জানেন না আদৌ তারা নিজেদের টাকা কখনও ফিরে পাবেন কি না।
যুবক-এর কাহিনি মনে নেই?
যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি, ওরফে 'যুবক' মোটা লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। বলেছিল, ১ লাখ টাকার বিনিয়োগের বিপরীতে প্রতি ছয় মাস অন্তর ৫০০০ টাকা মুনাফা দেওয়া হবে। এভাবে সংস্থাটি প্রায় সাড়ে ৩ লাখ বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে তাদের বিনিয়োগ করা ২,৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
২০০৬ সালে অবৈধ ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের দায়ে যুবকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার পর সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে কোম্পানিটির জন্য একজন প্রশাসনিক নিয়োগ দিয়ে আমানতকারীদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আর সাড়ে ৩ লাখ বিনিয়োগকারীর কেউই তাদের তাদের ২৫০০ কোটি টাকা ফেরত পাননি।
১৯৯৬ ও ২০১০-এর শেয়ার বাজার ধসের মূলেও রয়েছে এ ধরনের লোভ। অভিযোগ আছে, একটি গোষ্ঠী বাজারে কারচুপি চালিয়ে কিছু নির্দিষ্ট স্টক কিনতে বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে। লগ্নিকারীদের আশা দেয়া হয়েছিল যে, রাতারাতি তাদের বিনিয়োগ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
আবারও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় বাজার ফাঁপা বেলুনের মতো ফুলে-ফেঁপে ওঠে, এবং শেষে ঠাস করে ফেটে যায়।
সময় বদলেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গেছে ধোঁকাবাজির ব্যবসা। কিন্তু ভাঁওতাবাজদের আসল অস্ত্র একই আছে: লোভ।
এখন কিছু কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম 'অবিশ্বাস্য' অফার দিচ্ছে। বিশাল মূল্যছাড়—৩০% থেকে ৪০%—দিয়ে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করছে। বিশাল ছাড়ে পণ্য কেনার জন্য লোকে হুমড়ি খেয়ে অর্ডার বুক করছে। তাদের কারও কারও ভাগ্য ভালো, সময়মতো পণ্য পেয়ে যায়। কিন্তু বাকিরা পণ্যের অপেক্ষায় বসে থাকে মাসের পর মাস।
বাজারের এই অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির কারণে বাজারে নিয়ন্ত্রণহীন ই-কমার্স সাইটগুলোর মাধ্যমে হওয়া মোটা আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া অগ্রিম টাকার বিপরীতে অনলাইন শপগুলোর কোনো সম্পদ জমা নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে আটটি অনলাইন শপের মোট বিক্রি ছিল প্রায় ১,৩০০ কোটি টাকা। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, এই হিসেব কেবল একটি পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে পাওয়া। এরকম আরও অনেক আছে।
উদাহরণস্বরূপ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালীর দেনা বেড়ে ৪০৩.৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান সম্পত্তির মূল্য মাত্র ৬৫.১৭ কোটি টাকা।
ইভ্যালীর সম্পদ ও দেনার ব্যবধান অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি পুরনো দেনা মেটাবার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন দেনায় জড়িয়ে পড়ছে। ফলে ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছে দেনা বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বিশাল মূল্যছাড় দিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা অগ্রিম ইভ্যালী গ্রাহকদের টাকা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
তবু নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এখনও উচ্চ ছাড়ে পরিচালিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
এ গল্পের বার্তা পরিষ্কার। সবই লোভের কথা। একদল লোকের সুশৃঙ্খল প্রচেষ্টার ফাঁদে পা দিয়ে মানুষ অন্যায্য টাকার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে প্রতারণার শিকার হতে পারে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় এসব ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ফলে এ ধরনের প্রতারণা নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠছে।
- লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা ইংরেজিতে পড়ুন: When greed begets downfall
- বাংলায় অনুবাদ: মারুফ হোসেন