ইভ্যালির প্রকৃত দায় আরও বেশি হতে পারে: বাংলাদেশ ব্যাংক
ইভ্যালী ডট কমের দায়-দেনার প্রকৃত পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে এবং বিপুল দায়ের কারণে দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিটির অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব হতে পারে উল্লেখ করে কোম্পানিটির আর্থিক অনিয়মের ব্যাপকতা নিরূপণের জন্য একটি নিরপেক্ষ চার্টার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম দিয়ে সামগ্রিক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরিদর্শন দলকে ইভ্যালি ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যেসব তথ্য সরবরাহ করেছে, তার সঙ্গে ডাটাবেইজে রক্ষিত তথ্যে বড় ধরণের গড়মিল থাকার আশঙ্কা থেকে বিশেষ অডিট পরিচালনার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বলেছে, ইভ্যালিসহ কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান যাতে সামর্থ্যের অতিরিক্ত দায় সৃষ্টি করে নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ইভ্যালির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ইভ্যালির আইসিটি সিস্টেমে রক্ষিত লেনদেন সংক্রান্ত ডাটা ও পরিদর্শন দলকে ইভ্যালির সরবরাহ করা ম্যানুয়াল ডাটায় বিস্তর পার্থক্য থাকার কারণে এবং মাসভিত্তিক তথ্য সংরক্ষিত না থাকা ও তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ না করার অজুহাতে রেপ্লিকা ডাটাবেইজে পরিদর্শন দলকে অনুসন্ধান চালানোর সুযোগ না দেওয়া উদ্দেশ্যমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নয়।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত পরিদর্শন দলকে দেওয়া ইভ্যালির ম্যানুয়াল তথ্য অনুযায়ী গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৪০৩.৮০ কোটি টাকা। আর কোম্পানিটির চলতি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬৫.১৭ কোটি টাকা। আরও ৭৩ কোটি টাকার সমমূল্য গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ইভ্যালির ভার্চুয়াল আইডিতে। কিন্তু কোম্পানিটির ১০টি ব্যাংক হিসাবে মোট টাকা রয়েছে মাত্র ২ কোটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, 'পরিদর্শনকালে ইভ্যালি তাদের অতীতের হিসাবের খতিয়ানগুলো (বুকস অব একাউন্টস) দেখাতে পারেনি। কোম্পানিটির আর্থিক ব্যবস্থাপনা বোঝার জন্য মাসিক ভিত্তিতে বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ হতে মার্চেন্টদের পরিশোধিত অর্থ, গ্রাহককে ফেরত দেওয়া অর্থ, কোম্পানির পরিচালন ও অন্যান্য ব্যয় বাদ দেওয়ার পর বাকি অর্থ কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে ও নগদে রয়েছে কি-না, তা মিলিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল।'
কিন্তু ইভ্যালি মাসিক ভিত্তিতে এসব তথ্য সরবরাহ করেনি এবং সরবরাহ না করার কারণ হিসেবে কোম্পানির অতীতের আর্থিক লেনদেনের তথ্য সংরক্ষিত না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। কোন কোম্পানির অতীতের আর্থিক লেনদেনের হিসাব সংরক্ষণ না করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা কোম্পানির আর্থিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম ত্রুটি নির্দেশ করে- যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, কোন একটি কোম্পানির প্রতিটি আর্থিক লেনদেনের তথ্য সঠিক পদ্ধতিতে এন্ট্রি করা এবং তা সুনির্দিষ্ট মেয়াদকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করা আবশ্যক। অতীতের আর্থিক লেনদেনের তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমেই কোন একটি কোম্পানি তার ভবিষ্যতের আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করে থাকে। অতীতের আর্থিক লেনদেনের তথ্য ছাড়া কোম্পানির আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ ও ভবিষ্যতের সঠিক আর্থিক পরিকল্পনা করা অসম্ভব।
ইভ্যালির কাছে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি তার খুবই কম তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের দিয়েছে। কোম্পানির ডাটাবেইজে ঢুকতে না দেওয়ায় ওইসব তথ্যের সঠিকতাও যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ইভ্যালি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে সরাসরি কোন নির্দেশনাও দিতে পারেননি পরিদর্শক দলের কর্মকর্তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ জুন, ২০২০ তারিখে ইভ্যালির আর্থিক বছর সমাপ্ত হলেও পরিদর্শনকাল (১৪ মার্চ, ২০২১) পর্যন্ত আর্থিক বিবরণীর নিরীক্ষা সম্পন্ন ও অনুমোদন হয়নি। আগে যে প্রতিষ্ঠান দিয়ে নিরীক্ষা করতো, সে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছে এবং আর্থিক বিবরণী দাখিলের সময় বাড়াতে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এন্ড ফার্মসে আবেদন করা হয়েছে বলে মৌখিকভাবে জানালেও এর স্বপক্ষে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।
'চলতি অর্থবছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ইভ্যালির লোকসান তাদের মোট সম্পদের ২.৩৩ গুণ এবং শেয়ার মূলধনের ২১৩.৪৮ গুণ। কোন কোম্পানির লোকসান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া এবং মোট সম্পদের দ্বিগুণেরও বেশি ও শেয়ার মূলধনের দুইশত গুণেরও অধিক হারে লোকসান করা কোম্পানিটির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম ঘাটতি নির্দেশ করে। অদূর ভবিষ্যতে এই বিপুল পরিমাণ লোকসান কাটিয়ে উঠার কোন গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা না থাকায় দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানির অস্তিত্ব রক্ষাকেই অসম্ভব করে তুলতে পারে'- যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যথাযথ তদারকি চায় বাংলাদেশ ব্যাংক
সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দ্রুত বর্ধনশীল ই-কমার্স খাতের উপর গ্রাহকদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখতে যথাযথ তদারকির মাধ্যমে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোর জন্য যথাযথ একাউন্টিং সিস্টেম প্রণয়ন করে তা কোম্পানিগুলো অনুসরণ করছে কি-না, তা নিবন্ধিত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়মিত যাচাই করা প্রয়োজন।
'কোম্পানিগুলো যাতে সামর্থ্যের অতিরিক্ত দায় সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিজেরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয় বা বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট না করে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। ক্রেতা আকৃষ্ট করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে লোকসানে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে যেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন'- যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া, ই-কমার্স খাতের গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট নীতি ও পদ্ধতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ই-কমার্সখাতের মার্কেট প্লেস পরিচালনাকারী এবং বিক্রেতা উভয়েরই দায়িত্ব ও দায় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ
একই জেলার মধ্যে সাত দিন এবং ভিন্ন জেলার ক্ষেত্রে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া এবং ব্যর্থতায় মূল্য ফেরত দেওয়ার বিধান করে গত বছর অক্টোবরে একটি গাইডলাইনের খসড়া তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য বা মূল্য ফেরত না দিলে ক্রেতাদের জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মামলা করার সুযোগ রেখে তৈরি করা গাইডলাইনটি এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স সেলের প্রধান ও অতিরিক্ত সচিব মো. হাফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গাইডলাইনটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। খুব শিগগিরই এটি জারি করা হবে। এটি কার্যকর হলে ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
গত সোমবার বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে খসড়ার ওপর স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিতে একটি বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাতে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সুপারিশ উঠে এসেছে, যেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- কোন কোম্পানি অগ্রিম পণ্য মূল্য সংগ্রহ করলে তা অবশ্যই ১০ দিনের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে। যদি ১০ দিনের মধ্যে সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে কোম্পানি মনে করে, তাহলে অগ্রিম মূল্য নেওয়ার সাত দিনের মধ্যেই তা ক্রেতাকে ফেরত দিতে হবে।
ইভ্যালিসহ বেশ কিছু কোম্পানি অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পর পণ্য সরবরাহ না করে এডভান্স তারিখে ব্যাংক চেক ইস্যুর মাধ্যমে ক্রেতাকে রিফান্ড পরিশোধ করে। এটি বন্ধে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ক্রেতা যে মাধ্যম ব্যবহার করে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করবে, একই মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে ক্রেতাকে রিফান্ড করতে হবে। অর্থাৎ, ক্রেতা কোন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের বিকাশ বা নগদ ব্যবহার করে মূল্য পরিশোধ করলে রিফান্ডও বিকাশ বা নগদেই দিতে হবে।
মোটরবাইক, গাড়িসহ কোন পণ্য ওয়্যারহাউজে না থাকলে তার অগ্রিম মূল্য নিতে পারবে না কোন কোম্পানি। যদি কোন কোম্পানি নির্ধারিত ১০ দিনের বেশি সময় পর ডেলিভারি দেওয়ার শর্তে অগ্রিম মূল্য গ্রহণ করে, সে ক্ষেত্রে কোন মতেই পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অগ্রিম নেওয়া যাবে না।
ইভ্যালির রাসেল দম্পত্তির মাসিক বেতন ৯.৫ লাখ টাকা
বিপুল লোকসানী প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ইভ্যালীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানিটির ৪০ শতাংশ শেয়ারের মালিক মোহাম্মদ রাসেল মাসিক ৪.৫ লাখ টাকা এবং তার স্ত্রী ও ইভ্যালির চেয়ারম্যান এবং কোম্পানির ৬০ শতাংশ শেয়ারের মালিক শামীমা নাসরিন মাসে ৫ লাখ টাকা হারে বেতন নিচ্ছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া, রাসেল দম্পত্তি কোম্পানি হতে গাড়িসহ অন্যান্য সুবিধাও ভোগ করছেন।
ইভ্যালির সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, ৬২৬ জন কর্মকর্তা কর্মচারী প্রতিষ্ঠানটি হতে বেতন গ্রহণ করছেন। এদের মধ্যে বেশকিছু কর্মকর্তা উচ্চ হারে (সর্বোচ্চ ৮,০২,২৩০ টাকা) বেতন পাচ্ছেন।