সন্তানের সঙ্গে যা করবেন না
আমরা শিশুদের সাথে সেই আচরণই করি, যে আচরণ আমাদের পিতামাতা, পরিবার ও সমাজ আমাদের সঙ্গে করেছে। এই কাজটি আমরা মনের অজান্তেই করি, যার অধিকাংশই ভুল। সচেতনতার অভাবে অথবা না জানার কারণে বংশপরম্পরায় এই ব্যাপারটি চলতে থাকে। প্রায় সময়ই এমন আচরণ কিছু করি, যা সন্তানের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে। আমরা মনে করি- সন্তানের ভালোর জন্য করছি। অথচ এই আচরণগুলো যে ভুল তা আমরা নিজেরাই জানি না। আসুন, জেনে নিই সাধারণ কিছু ভুল।
>> কখনো নেতিবাচক কথা বলবেন না। সন্তানকে গর্দভ, অপদার্থ ইত্যাদি বলে গালি দিবেন না। পিতামাতার নেতিবাচক কথা সন্তানের মনোজগতে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়।
>> দুর্বলতা বা অক্ষমতা নিয়ে কখনো উপহাস করবেন না। এর ফলে সন্তান হীনমন্মতায় ভুগতে পারে।
>> এক সন্তানকে আরেক সন্তানের সাথে তুলনা করবেন না। যদি করেন, আপনি নিশ্চিত থাকেন, সন্তানদের মধ্যে ভবিষ্যতে সু-সম্পর্ক বা মিল থাকবে না। এর জন্যে আপনিই দায়ী থাকবেন।
>> সন্তানদের মধ্যে কোন বৈষ্যম করবেন না। কোন সন্তানের প্রতি আপনার মমতা একটু বেশি থাকতেই পারে, কিন্তু বস্তু দিয়ে তা দৃশ্যমান করতে যাবেন না। ছেলে আপন, মেয়ে পর- এই জাতীয় চিন্তাভাবনা থেকে বিরত থাকুন।
>> শিশুর সামনে স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করবেন না। এসব শিশুরা নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগে। যদি কোন কারণে মতপার্থক্য বা কথা কাটাকাটি হয়ে যায়, তাহলে অবশ্যই সন্তানের সামনেই তা মীমাংসা করবেন।
>> স্বামী বা স্ত্রী একে অন্যেকে জব্দ করার জন্যে সন্তানকে কখনো সাক্ষী করতে যাবেন না।
>> সন্তানের সামনে উচ্চস্বরে চিৎকার চেঁচামেচি করে কথা বলবেন না। যে পরিবারে সবাই আস্তে কথা বলে, সেখানে শিশুরাও আস্তে কথা বলে।
>> আপনি নিজে যা পালন করেন না, তা সন্তানকে উপদেশ দিতে যাবেন না।
>> শিশুকে মিথ্যা আশ্বাস দিবেন না। যদি আশ্বাস দেন তবে অবশ্যই তা পূরণ করবেন।
>> সন্তানের সামনে কারো গীবত বা বিদ্রুপ করবেন না। আপনি মিথ্যা বললে, সন্তানও এক সময় পাকা মিথ্যাবাদীতে পরিণত হবে।
>> অফিসে যাওয়ার সময় অবশ্যই শিশুর সামনে দিয়ে বের হবেন। শিশু কান্নাকাটি করলেও, কখনো লুকিয়ে বের হবে না।
>> গুন নয়, বরং সন্তানের প্রয়াস বা পরিশ্রমের প্রশংসা করুন।
>> অতি আদর বা অতি শাসনের মধ্যে দিয়ে শিশুকে বড় করবেন না। প্রয়োজন আদর ও শাসনের সুন্দর সমন্বয়।
>> শাসনের নামে শিশুকে প্রহার করবেন না। শারিরীক প্রহার শিশুর মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে এবং অন্য সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলে।
>> স্বামী অথবা স্ত্রী একজন শাসন করলে, আরেকজনকে চুপ থাকবেন। দুজন একসাথে শাসন করতে যাবেন না। এই সময়ে তাকে আদর, সান্ত্বনা, সমর্থন অথবা বুঝানো- কোনটিরই দরকার নেই। আপনার দায়িত্ব হলো শুধু চুপ থাকা।
>> ছোট শিশুর হাতে মোবাইল/ ট্যাব/ ল্যাপটপ কিংবা অন্য ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস তুলে দিবেন না। পাঁচ বছরের আগে টিভি কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে যত দূরে রাখতে পারবেন, তা শিশুর জন্যে ততই কল্যাণকর। শিশুকে কার্টুন এবং ভিডিও গেমস থেকে দূরে রাখুন- কার্টুন অথবা গেমস আসক্ত শিশুরা সাধারণত মারামারিতে অভ্যস্ত হয়। এছাড়া স্ক্রিন আসক্ত শিশুরা সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারেনা এবং বাস্তবতা বিবর্জিত হয়।
>> শিশুর সামনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার রোমান্টিক আলোচনা থেকে বিরত থাকুন। এতে করে শিশুর কোমল মনে বিরূপ প্রভাব পরতে পারে।
>> সন্তানের সাথে কোন ভুল হয়ে গেলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করুন, দুঃখিত বলুন। অযথা জাস্টিফাই করতে যাবেন না।
>> আদেশ বা উপদেশের ক্ষেত্রে- মা ও বাবা দুজনকে অবশ্যই এক সুরে কথা বলতে হবে। নির্দেশনা দুইরকম হলে সন্তান বিভ্রান্ত হয়। কোনটি পালন করবে তা বুঝে উঠতে পারে না।
>> সন্তান ভুল করলে সবার সামনে সমালোচনা করতে যাবেন না। যদি বলতে হয়, তবে একান্তে আড়ালে ডেকে বলুন। যখন মানসিকভাবে প্রশান্ত বা স্থির থাকে তখন বলুন।
>> আদরের নামে শিশুকে শারিরীক বা মানসিক নির্যাতন করবেন না। জংলি আদর থেকে বিরত থাকুন। এমন কিছু করবেন না যাতে শিশু বিরক্ত হয়।
>> শিশু কোন কাজে চেষ্টারত থাকলে, সহযোগিতার নামে তার প্রয়াসকে ভন্ডুল করবেন না। শিশু যখন মনোযোগ দিয়ে কোন কাজ করে, তাকে বাহাবাও দিতে যাবেন না।
>> আপনি যদি বুঝতে পারেন সন্তান দাবী আদায়ের জন্য আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করছে, তাহলে তার এই কৌশলের কাছে আত্ম-সমর্পণ করবেন না। দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে সে যদি নাছোড়বান্দা হয়, তাহলে তাকে বুঝাতে যাবেন না, ধমক দিবেন না, এমনকি তার দিকে
তাকাবেনও না। ছোট বেলা থেকেই তাকে এইভাবে অভ্যস্ত করাতে হবে, তা না হলে ভবিষ্যতে তা আপনার জন্য বিপদজনক হবে।
>> শিশুর সামনে সমস্যা নয় বরং সমাধান নিয়ে কথা বলুন। তাকে বুঝতে দিন- সমস্যা যত কঠিনই হোক, তা সমাধান করার যোগত্যা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন।
>> শিশুদেরকে জ্বিন-ভূত কিংবা ভয়ের গল্প বলবেন না। হরর মুভি দেখা থেকে বিরত রাখবেন।
>> আশেপাশের মানুষের আচরণ দেখেই সন্তানের মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হয়। তাই কুকুর/ তেলাপোকা/ টিকটিকি দেখলে ভয়ে দৌড় দিবেন না, সন্তানের সামনে যেকোন ব্যাপারে আতংকিত হবেন না।
>> শিশুদের সাথে জোর জবরদস্তি করতে যাবেন না। তাদের সাথে জবরদস্তি করলে তারাও বড় হয়ে অন্যের সাথে জবরদস্তি করবে।
>> শিশুকে মায়ের বুকের দুধ থেকে বঞ্ছিত করবেন না। যদি সম্ভব হয়, দুই বছর বুকের দুধ দিবেন।
>> শিশুকে জোর করে খাওয়াতে যাবেন না। খাওয়া নিয়ে আহ্লাদ করার দরকার নেই। সময় হলে সে নিজেই খাবে।
>> চিপস/ কোল্ড ড্রিংক/ ফাস্টফুড/ ভাজাপোড়া খাবার থেকে শিশুকে দূরে রাখুন।
>> সন্তানের কাছ থেকে প্রতিদান প্রত্যাশা করবেন না। মনে রাখবেন, সন্তান আপনার সম্পত্তি নয়, তাদের মানুষ করা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত এক মহান দায়িত্ব।
- লেখক: সমাজকর্মী ও গবেষক