ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব
দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে আবারো, কিন্তু আরও ভয়ঙ্কর মূর্তি ধরে।
ইতঃপূর্বে, প্রতিবেশী ভারতে বিপর্যয় ঘটিয়ে এবার বাংলাদেশেও সামাজিক সংক্রমণ ছড়াচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। প্রতিদিনই আসছে ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যুহারের দুঃসংবাদ।
আজ বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) নাগাদ বিগত ২৪ ঘণ্টায় ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। গত বুধবার ১১৫ জনের জীবনপ্রদীপ নেভায় কোভিড-১৯। তার আগে রোববার ১১৯ জন মারা যান। দেশের ৫০টির বেশি জেলাতে সংক্রমণ পরিস্থিতি নাজুক বলে ইতঃপূর্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান হারে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে- তা নিয়েও শঙ্কার অন্ত নেই বিশেষজ্ঞদের।
শঙ্কার সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ারও কারণ উঠে আসছে। গত ২৫ মে থেকে ৭ জুন নাগাদ রাজধানী ঢাকায় সংগৃহীত ৭০ শতাংশ নমুনায় পাওয়া গেছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। চলতি সপ্তাহজুড়ে ২৫ শতাংশের ঘরে অবস্থান করেছে সংক্রমণ হার।
বৈশ্বিক চিত্রও বেদনাদায়ক। ডেল্টা ধরনের বিস্তারই যার জন্য দায়ী। ফলে নতুন করে শক্তিশালী প্রাদুর্ভাবের কবলে পড়েছে বিশ্বের অনেক দেশ।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উদীয়মান বাজার অর্থনীতি ইন্দোনেশিয়ার অবস্থাও শোচনীয়। গোরখননকারীরা সেখানে রাত জেগে নতুন কবর খুঁড়ে চলেছেন। ইউরোপের দেশগুলো আবারও উচ্চ সংক্রমণ হার থাকা অঞ্চল থেকে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। বাংলাদেশে আজ বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) থেকে কঠোর লকডাউন চালু হওয়ার আগেই গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন শহরের অনেক পোশাক শিল্প শ্রমিক।
ফলে গ্রামাঞ্চলে রোগ বিস্তারের ঝুঁকি নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে জানায় মার্কিন দৈনিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্র এর আগে সংক্রমণ হার বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারলেও, এখন নতুন করে শনাক্ত হচ্ছে গুচ্ছ সংক্রমণ। চীনের কর্মকর্তারা গত সোমবার আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের জন্য ৫ হাজার কক্ষের এক বিশাল কোয়ারেন্টিন সেন্টার নির্মাণের ঘোষণা দেন। ভাইরাসের হিংস্রতা থেকে এতদিন নিশ্চিন্ত থাকা অস্ট্রেলিয়াও লাখ লাখ মানুষকে ঘরবন্দী থাকার নির্দেশনা দিয়েছে।
ভারতে প্রথম শনাক্ত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতো ভাইরাসের নতুন ধরনগুলো এশিয়া থেকে আফ্রিকা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। উন্নয়নশীল অনেক দেশ রেকর্ড মাত্রায় দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা জানাচ্ছে। এমন সময় এসব ঘটছে, যখন টিকাকরণে এগিয়ে থাকা অনেক ধনী দেশ মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা শিথিল করেছে। উন্নত এসব দেশে দৈনন্দিন জীবনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা শুরু করেছে। তবে ডেল্টার মতো বিপজ্জনক ধরনের বৈশ্বিক সংকটে সামান্যতম অসাবধানতাও তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সফলতাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মূল করোনাভাইরাসের চাইতে দ্বিগুণ সংক্রামক। তাছাড়া, টিকা পাওয়া ব্যক্তিদেরও এটি আক্রান্ত করার শক্তি রাখে, যা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যেই, ভারতে শনাক্ত হয়েছে ডেল্টা প্লাস নামক আরেকটি ধরন। নতুন আরও দুটি ধরন হলো; গামা ও লাম্বদা ভ্যারিয়েন্ট। এগুলো টিকাপ্রাপ্তদের দেহে আশ্রয় নিয়ে বংশবিস্তারের মাধ্যমে টিকা প্রতিরোধী সার্স কোভ-২ ভাইরাস জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
চলতি বছরের বসন্তে ভারতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এসময় মহামারিতে সরকারি হিসাবে দুই লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। কিন্তু, প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি বলেই অধিকাংশ সূত্র জানিয়েছে। ভারতের পর নেপালে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট এভারেস্টে আরোহনকারীদের দেহেও এটি শনাক্ত হয়। বাদ পড়েনি মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীরাও। ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে এটি যুক্তরাজ্যেও পৌঁছে যায়। আর এখন বাংলাদেশসহ প্রায় ৮৫টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেল্টা। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে সংক্রমণের মূল উৎসই হয়ে উঠেছে এ স্ট্রেইন।
এব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অবস্থিত কোরিয়া ইউনিভার্সিটি গুরো হসপিটালের বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কিম ও-জো বলেন, "ভাইরাসের নতুন ধরনের বিস্তার রুখতে আমাদের এখন কোমর বেঁধে দৌড়াতে হচ্ছে।"
মাস্ক বাধ্যতামূলক করাসহ আবারও লকডাউন দেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে মালয়েশিয়া ও দ্বীপরাষ্ট্র সিশেলসে। একই ধরনের বিতর্কের সুর শোনা যাচ্ছে তুলনামূলক অনেক বেশি সম্পদশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহেও।
যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলস কাউন্টিতে সবচেয়ে বেশি বাড়ছে ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ। গত সোমবার আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা টিকাপ্রাপ্তসহ সকলকে প্রতি বাড়ির ভেতরেও মাস্ক পরার অনুরোধ করেছেন।
নেপাল ও কেনিয়ায় আসিইউ শয্যাগুলো রোগীতে ভর্তি। এ দুটি দেশে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকদের মৃত্যুর চিত্র যেন বিশ্বকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এপর্যন্ত আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ টিকাগুলো ডেলটা ভারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কমবেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, টিকাপ্রাপ্তরা আক্রান্ত হলে মৃদু বা উপসর্গহীন অসুস্থতার শিকার হতে পারেন। কিন্তু উদ্বেগের কারণ; অতি ক্ষুদ্র জনসংখ্যার কিছু রাষ্ট্র ছাড়া ধনী দেশেও মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম সংখ্যককে সম্পূর্ণরূপে টিকার আওতায় আনা গেছে।
এ বাস্তবতায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো বিস্তার লাভ করতে থাকায় টিকা কর্মসূচিতে আরও জোর দেওয়ার পাশাপাশি সতর্কতার সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে আবার নতুন করে মৃতের সাড়ি বৈষম্যকে প্রকট করছে। স্পষ্ট হয়েছে, প্রাণরক্ষাকারী প্রতিষেধক থাকা ধনী দেশের সঙ্গে অনুন্নত জাতিগুলোর টিকা না পাওয়ার দুর্দশা। বিশ্ব নেতাদের বড় বড় বুলি ও গালভরা প্রতিশ্রুতির পরও টিকার অসম বণ্টনই মহামারিকে নতুন এ গতি দিয়েছে। বাড়িয়েছে সংক্রমণের মাত্রা ও ভাইরাসের ভয়াবহতা।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ডার্বির জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবার জ্যেষ্ঠ প্রভাষক এবং ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দোনো উদিয়াতমোকো বলেন, "ধনী দেশগুলোর হাতে অর্থ ও বৈজ্ঞানিক সম্পদ দুটোই ছিল। সম্পদ কাজে লাগিয়ে আগে তারা নিজেদের জনসংখ্যাকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়, যা স্বাভাবিক; কিন্তু, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সব জীবনের মূল্যই সমান হওয়া উচিত।"
তাছাড়া, বিশ্বের সকল অঞ্চল মহামারি থেকে মুক্তি না পেলে পৃথিবীর কোনো স্থানই ভাইরাসের মারণ থাবা থেকে নিস্তার পাবে না, মহামারি ইতোমধ্যে তা বেশ কয়েকবার প্রমাণ করেছে। নতুন ধরনের বিস্তারও দিচ্ছে সেই একই ইঙ্গিত।
এদিকে আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও দ্রুত টিকাকরণের জন্য যে পরিমাণ ডোজের দরকার ছিল বাংলাদেশ যে তার চেয়ে অনেক কম ডোজ পেয়েছে সেকথাও উল্লেখ করে মার্কিন দৈনিকটির প্রতিবেদন। সেখানে বলা হয়, এপর্যন্ত মাত্র ৩ শতাংশেরও কম বাংলাদেশি সম্পূর্ণরূপে (দুই ডোজ) টিকা পেয়েছেন।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।