মহামারিকালেও বিনিয়োগ বেড়েছে টেক্সটাইল শিল্পে
করোনা মহামারির মধ্যেও উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে ও নতুন প্রযুক্তির জন্য পোশাক খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন টেক্সটাইল উদ্যোক্তারা। দেশের পোশাক খাতের ক্রমবর্ধমান রপ্তানি চাহিদা মেটাবার জন্যই বাড়ছে বিনিয়োগ।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ খাতে ৪২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ বিনিয়োগের উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাবার জন্য উৎপাদন মান বাড়ানো ও উৎপাদন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা। আন্তর্জাতিক বাজারে কৃত্রিম তন্তুর চাহিদা বেশি বলেই জানিয়েছেন তারা।
ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচির কারণে বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় দুই বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মহামারি প্রকোপ কমে গেছে। ফলে এই বাজারগুলোতে তৈরি পোশাকের চাহিদা এখন আবার প্রায় কোভিডপূর্ব সময়ের সমান বলে জানিয়েছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
অনেক কারখানা মালিক এত বেশি অর্ডার পেয়েছেন যে বর্তমান সক্ষমতা নিয়ে সময়মতো অর্ডার ডেলিভারি দিতে পারবেন না। এছাড়া চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধও দেশের উদ্যোক্তাদের তন্তু এবং ফ্যাব্রিকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের বরাতে আরও জানা যায়, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবে দেশের পোশাক খাত পলিয়েস্টার, সিন্থেটিক, ভিসকোস লিক্রা-র (কৃত্রিম তন্তু হিসেবে পরিচিত) মতো মিশ্র তন্তু ও ফ্যাব্রিক উৎপাদনে পিছিয়ে আছে। ক্রেতাদের চাহিদা মেটাবার জন্য দেশের উদ্যোক্তাদের এখনও এ জাতীয় তন্তু ও ফ্যাব্রিক আমদানি করে আনতে হয়।
বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো ইতোমধ্যে এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য তাদের প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়েছে। এ কারণেও দেশের উদ্যোক্তারা কারখানার আধুনিকীকরণ ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছেন।
স্টেকহোল্ডারদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, নতুন বিনিয়োগের ফলে প্রায় ৬,০০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিটি কারখানা এখন বিএমআরই (ব্যালেন্সিং, মডার্নাইজেশন, রিহ্যাবিলিটেশন, এক্সপেনশন)—অর্থাৎ ভারসাম্যকরণ, আধুনিকায়ন, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করছে।
তিনি আরও জানান, গত দশ বছরে যেসব কারখানা এসব খাতে বিনিয়োগ করেনি, তারা এখন ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছে।
সুতি ও কৃত্রিম ফ্যব্রিকসহ টেক্সটাইল পণ্যের চাহিদা বেড়েছে জানিয়ে মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'বর্তমানে আমার কারখানায় প্রতিদিন ১০০ টন কাপড়ের রপ্তানি অর্ডার রয়েছে। কিন্তু আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৬০ টন।'
স্থানীয় উদ্যোক্তা ছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও কৃত্রিম ফ্যাব্রিক উৎপাদনের জন্য দেশে কারখানা স্থাপনের জন্য এগিয়ে আসছেন।
কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের মালিক, বিখ্যাত কোরিয়ান শিল্প গ্রুপ ইয়ংগোন কোরিয়ান এ বছরের প্রথম দিকে ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা কৃত্রিম ফ্যাব্রিক উৎপাদনে ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
বিটিএমএর তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে ৪৩৩টিরও বেশি স্পিনিং মিল চালু ছিল। এ কারখানাগুলো বছরে সম্মিলিতভাবে ৩২৭০ টন কেজি তন্তু উৎপাদনে সক্ষম।
স্থানীয় উৎপাদকরা নিটওয়্যারের জন্য প্রয়োজনীয় তন্তু ও ফ্যাব্রিকের প্রায় ৮৫-৮৯ শতাংশ সরবরাহ করতে সক্ষম।
বিটিএমএ-র তথ্যানুযায়ী, বোনা কাপড়ের খাতে যে পরিমাণ তন্তুর চাহিদা আছে, স্থানীয় তাঁতিরা তার ৪০ শতাংশের কম সরবরাহ করতে পারে। এ কারণে কারণে বোনা পোশাক শিল্প বিদেশি ফ্যাব্রিকের ওপর নির্ভরশীল।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক পোশাক নির্মাতাদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারার ফেডারেশন-এর (আইটিএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত মোট পোশাকের ৭৮ শতাংশই কৃত্রিম তন্তু থেকে তৈরি হয়। বাকি ২২ শতাংশ তৈরি হয় তুলার তন্তু থেকে।
কিন্তু কৃত্রিম তন্তু তৈরি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেছেন, 'এ কারণেই আমরা এই পণ্যগুলোর জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল।'
দেশের শীর্ষ দশ স্পিনিং মিলগুলোর একটি, ম্যাকসনস গ্রুপ ঘোষণা দিয়েছে যে তারা মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে তিনটি নতুন স্পিনিং ইউনিটে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে।
গ্রুপটির সহপ্রতিষ্ঠান মেট্রো স্পিনিং লিমিটেড একটি ইউনিটে ৩৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। ম্যাকসনস স্পিনিং মিলস আরও দুটি ইউনিটে ২৫৪ কোটি ও ৩৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে জানিয়েছে কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
ম্যাকসনস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোকন বলেছেন, 'আমরা উচ্চমূল্যের বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনের জন্য বড় বিনিয়োগের যাচ্ছি, আমরা বাজারের প্রতিযোগিতায় ভালোমতো টিকে থাকতে পারি।'
ম্যাকসনস গ্রুপের মতো এনভয় গ্রুপ, নিউ এশিয়া গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, প্রাইড গ্রুপ, শাশা গ্রুপও মহামারিকালে বিপুল বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এনভয় টেক্সটাইলসের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মিশ্র তন্তু উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে। তারা আশা করছেন, এর ফলে ওভার-রেট খরচ কমে আসবে।
কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'পুরনো কারখানা হিসেবে আমাদেরকে নতুনদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম বিনিয়োগ করতে হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় কাপড়ের চাহিদা শিগগিরই মহামারিপূর্ব সময়ের চেয়েও বেড়ে যেতে পারে ধারণা করে তাদের কোম্পানির সক্ষমতা অগ্রাধিকার ঠিক করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, বিক্রির জন্য যাতে কোনো মার্কেটিং করতে না হয়, সেজন্য তার প্রতিষ্ঠান উন্নতমানের ফ্যাব্রিক তৈরি করে।
তিনি বলেন, 'চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণেও আমাদের মিশ্র তন্তু উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আগে এ তন্তু চীন থেকে আমদানি করা হতো।
পোশাক খাতের আরেক বড় রপ্তানিকারক ডিবিএল গ্রুপ সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ৫৬২ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিল্প গ্রুপটি তাদের হামজা টেক্সটাইল মিল—ইউনিট ২-এর ডাইং ও ফিনিশিং সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ৩৭৬ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছে।
শিল্প গ্রুপটি কৃত্রিম তন্তুসহ বিশেষ ধরনের তন্তু উৎপাদনের জন্য মতিন স্পিনিং মিলস-এ একটি নতুন ইউনিটও স্থাপন করেছে। এই নতুন উদ্যোগের জন্য প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা প্রয়োজন।
ডিবিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আশা করছেন, নতুন ইউনিটগুলো এ বছরের শেষ নাগাদ উৎপাদনে যেতে পারবে। এর ফলে প্রায় ২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
নিউ এশিয়া গ্রুপ তাদের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি আধুনিকায়নের জন্য ২১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ মতিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেছেন, 'তারা যে যে সুতা উৎপাপন করে, ক্রেতাদের কাছে তার ভালো চাহিদা আছে। কারণ আমরা আমেরিকা থেকে তুলা আমদানি করে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সুতা তৈরি করি।'
তিনি আরও বলেন, 'গোটা বিশ্বেই প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তন্তুর মানও বদলে গেছে। সেজন্য আমরা আরও উন্নত মানের সুতা উৎপাদনের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করছি।'
কোভিড মহামারির কারণে ব্যবসা এখন খারাপ অবস্থায় আছে উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এ পরিস্থিতি বেশিদিন থাকবে না। তিনি বলেন, 'এর (মহামারি) কারণে ব্যবসা বন্ধ থাকবে না। সেজন্য আমরা তুলাভিত্তিক তন্তুর ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য তৈরি হচ্ছি।'
প্রাইড গ্রুপের অঙ্গসংগঠন এইচআর টেক্সটাইল তাদের সক্ষমতা বাড়াতে ৮০ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে।
শিল্প গ্রুপটির পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেছেন, 'টেকসই পণ্য উৎপাদনের জন্য আমরা আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। কারণ বিশ্বজুড়ে ক্রেতারা শক্তি, রাসায়নিক দ্রব্য ও পানি খরচের দিক থেকে আরও পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই প্রেক্ষাপটে পরিবেশবান্ধব করার লক্ষ্যে আমাদের পোশাক কারখানার বিদ্যমান রাসায়নিক এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টকে (ইটিপি) বায়োলজিক্যাল ইটিপিতে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।'
প্রতিষ্ঠানটিকে আরও দক্ষ ও উৎপাদনকেন্দ্রিক করে তুলতে কিছু সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্র স্থাপনের পরিকল্পনাও নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আবদুল মোমেন। তিনি বলেন, 'গ্রীষ্ম ও শীতকালের জন্য আমরা উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন করছি। এ কারণে সারা বছর ধরেই আমাদের কাছে অর্ডার আসতে থাকে।'
তিনি আরও বলেন, বর্ধিত সক্ষমতার কারণে তাদের কোম্পানি বিদ্যমান ক্রেতাদেরকে বাড়তি কিছু বৈচিত্র্যময় পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন। ফলে কোম্পানির টার্নওভারও বাড়বে।
টেকসই পণ্য উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে শাশা ডেনিম জমি কেনার জন্য ইতোমধ্যে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ জানিয়েছেন, তারা বিদ্যমান সক্ষমতা ব্যবহার করে আরও বেশি উচ্চমান সম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন।
এছাড়াও সুতা কাটা রিসাইকেলিংয়ের জন্য একটি নতুন প্ল্যান্ট ও পরিবেশবান্ধব ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
নতুন প্রকল্পটিতে প্রায় ৫ কোটি মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হবে বলে জানান শামস মাহমুদ।
গত বছর ডেনিম মিলটি ইতালিয়ান টেক্সটাইল মিল ইওএস টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের একটি অংশও কিনে নেয়।
রপ্তানি পরিস্থিতি:
২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ১৭৬ শতাংশ বেড়ে পেয়ে ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে ওভেন পোশাকের রপ্তানি ১৯৮ শতাংশ বেড়ে ১৬.৬৩ বিলিয়ন ডলার এবং নিট পোশাকের রপ্তানি ১৬৫ শতাংশ বেড়ে ১৬.৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে দেশ ২৮.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-র (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, মোট রপ্তানির এই পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১.১ শতাংশ বেশি, কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ কম।
পোশাক রপ্তানিকারকরা আশা করছেন, এই অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।