জমে উঠেছে খেজুর গুড়ের হাট
তীব্র শীত উপেক্ষা করে রাজশাহীতে জমে উঠেছে খেজুর গুড়ের হাট। স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর নজরদারির কারণে এবার উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে ভেজালমুক্ত গুড়। তবে দাম নিয়ে হতাশ চাষিরা। কৃষি অধিদফতর বলছে, রাজশাহীতে এবার শীতের মৌসুমে গুড়ের ব্যবসা হবে ৪১ কোটি টাকার।
শীত মৌসুম এলেই ঘন কুয়াশা ও ঠাণ্ডার মধ্যে গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহ করেন। পরে তা জ্বাল দিয়ে তৈরি করেন খেজুর গুড়। রাজশাহীর বানেশ্বর ও ঝলমলিয়া হাটে নিয়ে তা বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। শীত এলেই রাজশাহীতে জমে উঠে খেজুর গুড়ের হাট।
গত ২৪ ডিসেম্বর বানেশ্বর হাটে গিয়ে দেখা যায়, ভোর থেকেই জমে উঠেছে খেজুর গুড়ের হাট। বানেশ্বর ভূমি ইউনিয়ন অফিসের মাঠে বসা এই হাটে ভোর থেকেই শুরু হয়েছে বেচাকেনা।
চারঘাটের চাষী ইয়াকুব মণ্ডল জানান, তার বাড়িতে ৭০টি খেজুর গাছ রয়েছে। সেগুলো থেকে তিনি সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ কেজি গুড় পান। সেসব গুড় তিনি বানেশ্বর হাটে নিয়ে বিক্রি করেন।
দুর্গাপুরের চাষী তাহের আলী জানান, তার রয়েছে একশোর মতো খেজুর গাছ। সেসব গাছ তিনি নিজে কেটে রস নামান। এরপর তা জ্বাল দিয়ে তৈরি করেন গুড়। সেই গুড় তিনিই হাটে নিয়ে এসে বিক্রি করেন।
হাটের বেশিরভাগ গুড় বিক্রেতা এসেছেন দুর্গাপুর, পুঠিয়া, বাঘা ও চারঘাট উপজেলা থেকে। তাদের মধ্যে কেউ নিজেরাই গাছ থেকে রস নামিয়ে খেজুর গুড় তৈরি করেন। আবার কেউ অন্যের খেজুর গাছ ইজারা নিয়ে রস সংগ্রহ করে গুড় উৎপাদন করেন।
তবে খেজুর গুড়ের দাম নিয়ে হতাশ চাষীরা। তারা বলছেন, চিনি মিশিয়ে চাকচিক্য না বাড়ালে খেজুর গুড়ের ভালো দাম পাওয়া যায় না। ব্যবসায়ীরা তখন নিতেও চান না। ব্যবসায়ীদের কারণে বাধ্য হয়েই চাষীরা গুড়ে চিনি মেশান।
দুর্গাপুর উপজেলার চাষী মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পরিস্থিতি এমন করেছে যে, চিনি না মেশালে তারা গুড় নিতেই চান না। চিনি মেশালে উজ্জ্বল দেখায়, তখন দাম ভালো পাওয়া যায়।’’
পুঠিয়ার বানেশ্বর এলাকার চাষী তৌফিক এলাহী বলেন, ‘‘এ বছর প্রশাসনের ব্যাপক নজরদারি ছিলো। ফলে ভেজাল কোনো গুড় উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে বাজারে গুড়ের দাম কম।’’
চাষীরা বলছেন উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকের মূল্য ধরলে সেই তুলনায় গুড়ের দাম কম।
দুর্গাপুরের চাষী শাহ জামাল বলেন, আমার দেড়শোর মতো খেজুর গাছ আছে। দু’জন গাছি পালা করে গাছ কেটে খেজুর রস সংগ্রহ করেন। সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়।
তিনি বলেন, ‘‘উৎপাদন খরচ ও দিনমজুরদের দাম ধরলে বাজারে যে দাম সে অনুযায়ী লাভ হয় না। বাজারে ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি হচ্ছে। এই দাম যদি ৮০ থেকে ৯০ টাকা হতো তাহলে পর্যাপ্ত লাভ হতো।
বাঘার কৃষক ইদরিস আলী বলেন, সিন্ডিকেট ব্যবসার কারণে মূলত কৃষকরা দাম কম পাচ্ছেন।
গত মঙ্গলবার বানেশ্বর হাটে গিয়ে দেখা যায়, পাইকারি ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে। আর রাজশাহীর শহরে সেই গুড় খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর মৌসুমের শুরু থেকেই ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দরে খেজুর গুড় বিক্রি হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহে দুইদিন বসে বানেশ্বর হাট। এখান থেকে গুড় কিনে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠান। এছাড়া দেশের বাইরেও পাঠানো হয় এসব গুড়। প্রতিদিন হাটে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ টন গুড় আমদানি হয়।
ঢাকা থেকে গুড় কিনতে এসেছেন রুবেল আহসান। তিনি গুড় কিনে ঢাকার বিভিন্ন মোকামে পাঠান। এছাড়া কেনা গুড় জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত ও আবুধাবিতে পাঠাবেন।
রুবেল আহসান জানান, তিনি প্রতি হাটে ৪ থেকে ৫ টন খেজুর গুড় কিনে থাকেন। সেগুলো প্যাকিং করে ঢাকায় পাঠান। তার মতো এরকম আরও ১০০ জন ব্যবসায়ী রয়েছেন। যারা এখান থেকে গুড় কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, খেজুর গুড় উৎপাদনের সঙ্গে ৩০ হাজার মানুষ জড়িত। এ বছর রাজশাহীতে ৪১ কোটি টাকার খেজুর গুড়ের বাণিজ্য হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, রাজশাহী জেলায় ৫৯২ হেক্টর জমিতে গাছের সংখ্যা রয়েছে ৮ লাখ ৮৮ হাজার। গাছ প্রতি গড় উৎপাদন ৭ দশমিক ৭ কেজি হিসেবে ধরলেও মোট গুড় উৎপাদন হবে ৬ হাজার ৮৩৫ টন। গড়ে কেজিপ্রতি গুড়ের দাম ৬০ টাকা ধরলেও এ মৌসুমে ৪১ কোটি টাকার গুড়ের বাণিজ্য হবে।