আইসিডিতে কনটেইনার জটে ব্যাহত রপ্তানি বাণিজ্য
জাহাজ সংকট এবং সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালেশিয়ার পোর্ট ক্লাংয়ের মতো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে অচলাবস্থার কারণে দেশে ভয়াবহ কনটেইনার জটের সৃষ্টি হয়েছে। রপ্তানিকৃত প্রায় ১০০ শতাংশ পণ্য বোঝাইয়ের কাজে নিয়োজিত অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোগুলোতে (আইসিডি) সৃষ্ট সংকটের ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের রপ্তানি কার্যক্রম।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) এবং পণ্য পরিবহনকারীদের মতে কনটেইনার জটে বিদ্যুৎগতিতে বাড়ছে পরিবহন খরচ।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মতে, অফ-ডক নামে পরিচিত ১৯টি আইসিডির মোট ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টিইইউ (২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট)। কিন্তু, বর্তমানে বন্দরে যাওয়ার জন্য ডিপোগুলোতে অপেক্ষায় রয়েছে ১৪ হাজার টিইইউ সমপরিমাণ রপ্তানি পণ্য।
সাধারণত আইসিডি থেকে জাহাজে তোলার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো কনটেইনার পাঠাতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগে বলে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু, বর্তমানে একই কাজ করতে সাত থেকে ১০ দিন সময় লাগছে। ফলে, ডিপোগুলোর বাইরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান।
বিকডার সেক্রেটারি রুহুল আমিন শিকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জাহাজ সংকটের কারণে পণ্য পাঠাতে দেরি হওয়ায় আইসিডিতে রপ্তানি কনটেইনারের স্তূপ জমে গেছে।
গত কয়েকমাস ধরেই চলমান এই সংকট দিনদিন তীব্র হচ্ছে বলে মনে করছে বিকডা।
পয়লা জুলাই বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিকডা সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান জানান, "ফরওয়ার্ডাররা কারগো বোঝাইয়ের পরিকল্পনা (সিএলপি) জানাতেও দেরি করছে। ফলে, আমাদের কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশনে (সিএফএস) স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দীর্ঘ সময় ধরে রপ্তানি পণ্যগুলো পড়ে থাকছে। যার কারণে সিএফএস ধারণ ক্ষমতার মাত্রা অতিক্রম করছে।"
দীর্ঘ সময় ধরে রপ্তানি কনটেইনারগুলো জায়গা দখল করে রাখায় "নতুন কারগোর রপ্তানি পণ্য নিয়ে অফ-ডকে আসা ট্রাকগুলো থেকে পণ্য নামাতে দেরী হচ্ছে" বলে উল্লেখ করেন তিনি।
"সম্পূর্ণ পরিচালনা চক্র ধীরে চলতে থাকায় আইসিডির কর্মক্ষমতাকেও প্রভাবিত করছে," বলেন নুরুল কাইয়ুম খান।
জাহাজে রপ্তানি পণ্য তুলতে বিলম্ব হওয়ায় আইসিডির চলমান সংকটের কথা জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইনকনট্রেড লিমিটেড আইসিডি প্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আমাদের আইসিডির সামনে ২-৩ দিন ধরে অসংখ্য পণ্যবোঝাই কাভার্ড ভ্যান এবং ট্রাকের দীর্ঘ লাইন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, এখন এখানে পণ্য নামানোর মতো কোনো ফাঁকা জায়গা নেই।"
ডিপোটির দুই হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সব জায়গা পরিপূর্ণ থাকায় বহু রপ্তানি পণ্য এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আইসিডি প্রাঙ্গণে পড়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর চলমান সংকটকে "রপ্তানির জন্য বড় বিপর্যয়" হিসেবে মন্তব্য করেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "ডিপোগুলোর সামনে ৩-৪ দিন ধরে আমাদের রপ্তানি পণ্যবোঝাই ২৭টি কাভার্ড ভ্যান অপেক্ষা করছে। কিন্তু ডিপোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় তারা পণ্যগুলো নামাতে পারছে না। দীর্ঘ সময় ধরে কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাকগুলো আটকে থাকায় দেরি হওয়ার কারণে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।"
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) ভাইস প্রেসিডেন্ট তানভীর আরও জানান, "চালান পাঠানোতে দেরি হওয়ায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখানো সম্ভব হচ্ছে না বলে আমরা টাকাও পাচ্ছি না। ফলে নগদ অর্থ সংকটে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির পুরো প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে পড়েছে।"
বাংলাদেশি রপ্তানি কনটেইনারের ১০ থেকে ১১ শতাংশ এবং আমদানি কনটেইনারের ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ পরিবহন করে থাকে জার্মান শিপিং প্রতিষ্ঠান হ্যাপাগ-লয়েড।
প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় এজেন্ট জিবিএএক্স লজিস্টিক্সের স্বত্বাধিকারী গ্যালাক্সি বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট শামসুদ্দীন আহমেদ চৌধুরী মিনার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কনটেইনারবাহী বড় জাহাজের (মাদার ভেসেল) সময়সূচীতে ব্যাঘাত এবং ফিডার ভেসেল আটকে থাকায় দেশে আসা এবং বিদেশগামী কনটেইনার পরিবহনে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ফিডার ভেসেলগুলো স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে গড়ে মাসে ২ থেকে ২.২ বার সমুদ্র পাড়ি দিলেও বর্তমানে জটের কারণে বন্দরে ভিড়তে দেরি হওয়ায় গড়ে তা মাসে ১.৫ বারে নেমে এসেছে।"
নির্ধারিত কনটেইনারে রপ্তানি পণ্য বোঝাইয়ের পর আইসিডি জাহাজ নির্বাচনে নিয়োজিত শিপিং লাইনে বোঝাই সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠায়। পরবর্তীতে, নির্ধারিত জাহাজে কনটেইনার তোলার জন্য সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়।
তবে, জাহাজ সংকটের কারণে সময় অনুযায়ী তালিকা তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার কথা জানিয়েছে শিপিং লাইনসমূহ।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের ডিরেক্টর খাইরুল আলম সুজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "আমদানি ও রপ্তানি উভয় তরফের বাণিজ্য স্বাভাবিক থাকায় আগে এখানে ভারসাম্য ছিল। মহামারির কারণে আমদানি কমে যাওয়ায় কনটেইনার সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে যেসব কনটেইনার আসে পরবর্তীতে সেগুলো বোঝাই করে রপ্তানি পণ্য পাঠানো হত।"
"খেলনার মতো নিত্য-ব্যবহার্য নয় এরকম বহু পণ্য আগে ইউরোপ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে তা বন্ধ হয়ে গেছে। অধিকাংশ আমদানিকারকই বর্তমানে কেবল প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো আমদানি করছে। ফলে, বাণিজ্য ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। বহু জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানই এখন আর বড় জাহাজগুলো চালাচ্ছে না। এছাড়া, সুয়েজ খালে জাহাজ আটকে পড়ার ঘটনায় ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে জটের সৃষ্টি হয়েছে।"
"আমরা জানি না যে এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তাও আমরা বুঝতে পারছি না," বলেন তিনি।
সিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, "সংকটের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজারে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এই পরিস্থিতিতে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহনে বিশেষ ফিডার ভেসেলের ব্যবস্থা করা গেলে কিছুটা হলেও সংকট কমবে।"
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জাহাজে পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে। আসন্ন বসন্ত ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের জন্য কিছু ক্রয়াদেশ আসবে বলে আমরা আশা করছি। কিন্তু, সংকটের কারণে আমরা সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে নতুন ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রেও তা প্রভাব ফেলবে।"
বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় থাকা আমদানি কনটেইনারগুলোও ট্রান্সপোর্ট বন্দরে জটের কারণে আটকে আছে।
সিঙ্গাপুর পোর্টে ভয়াবহ জটের কারণে জার্মান শিপিং প্রতিষ্ঠান হ্যাপাগ লয়েড ২৪ জুন থেকে এক মাসের জন্য সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে আসা আমদানি কনটেইনারের বুকিং স্থগিত করেছে।
বাড়ছে সমুদ্রপথে পরিবহন খরচ
বাফার সূত্রানুসারে, মহামারি পূর্ব সময়ের তুলনায় বর্তমানে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসা দুটি নিয়মিত পথে পরিবহন খরচ (ফ্রেইট চার্জ) প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশই এই দুটি রুটে পাঠানো হয়ে থাকে বলে উল্লেখ করেন বাফা পরিচালক খাইরুল আলম সুজন। তিনি বলেন, "মহামারির আগে ইউরোপের রুটে ৪০ বর্গফুটের একটি কনটেইনারের ফ্রেইট চার্জ ছিল ৩০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে তা বেড়ে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলারে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রগামী ৪০ বর্গফুটের কনটেইনারের খরচ আগে ৫ হাজার ডলারের নিচে থাকলেও এখন তা ৯ হাজার ডলারের ওপর গিয়ে পৌঁছেছে।"
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, "ফ্রেইট চার্জ বাড়তে থাকায় আমরা উদ্বিগ্ন। উচ্চ পরিবহন খরচের কারণে ক্রেতারা আমাদের কাটিং এবং পণ্য উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা পিছিয়ে পড়ব।"