২০২৩ সালের আগে কোভিড টিকা পাচ্ছে না দরিদ্র দেশগুলো
বিশ্বের ৭০ শতাংশ মানুষকে পূর্ণ ডোজ টিকার আওতায় আনার জন্য প্রায় ১১০০ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন। ৪ জুলাই পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৩২০ কোটি ডোজ। দাতা গোষ্ঠী আইএমএফ-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, এ গতিতে টিকাদান চলতে থাকলে এ বছর শেষে প্রায় ৬০০ কোটি ডোজ টিকা দেওয়া সম্পন্ন হবে।
তবে এখন পর্যন্ত ৮০ শতাংশের বেশি টিকাই পেয়েছে উচ্চ ও উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশগুলো। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ কেবল এক ডোজ টিকা পেয়েছেন।
গত মাসে ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি-৭-এর নেতারা ২০২২ সালের মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশলোকে বাড়তি টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফাইজার-বায়োএনটেকের ৫০ কোটি টিকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে তিনি আরও ৮ কোটি ৭৫ লক্ষ টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য ১০ কোটি এবং ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান প্রত্যেক দেশ ৩ কোটি করে টিকা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
নর্থ ক্যারোলিনার গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টারের গবেষকদের গত ২ জুলাইয়ের দেওয়া তথ্যানুসারে, চীন কমপক্ষে ৫৯টি দেশে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডোজ টিকা পাঠিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালক অ্যান্ড্রিয়া টেইলর জানিয়েছেন, ধনী দেশগুলোর এ প্রতিশ্রুতির পরও দরিদ্র দেশগুলোর টিকা পাওয়ার গতি বাড়বে না। অ্যান্ড্রিয়ার দল গত মার্চে জানিয়েছিল, ২০২৩ সালের আগে সারা বিশ্বে টিকা পৌঁছানো সম্ভব নয়। এখনও সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি বলে জানান তিনি।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার জন্য প্রতিশ্রুত বাড়তি টিকা পাঠানো বাধাগ্রস্ত হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এখনও কিছু টিকা এবং টিকার উপাদান রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। যে পরিমাণ টিকা দেওয়া হবে বলে কথা দিয়েছিল, সেই পরিমাণ টিকা যেন আগে ইইউকে সরবরাহ করা হয়- তার জন্য টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে ইইউ।
বিশ্বের মোট টিকার ৬০ শতাংশই ভারতে উৎপাদিত হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটি কোভিড-১৯-এর টিকা রপ্তানি বন্ধ করতে উৎপাদকদের আদেশ দেয়। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বিতরণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেওয়া কোভ্যাক্স কর্মসূচির টিকা রপ্তানিও বন্ধ করে দিয়েছে ভারত।
কোভ্যাক্স প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এই বছরের শেষ নাগাদ ২০০ কোটি টিকা সরবরাহ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর ২০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হবে। কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় ২৪০ কোটি ডোজ টিকা কেনা হয়েছে। কিন্তু গত গত ২ জুলাই পর্যন্ত কোভ্যাক্স মাত্র সাড়ে ৯ কোটি টিকা সরবরাহ করতে পেরেছে।
এদিকে আফ্রিকাজুড়ে কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কঙ্গো দপ্তর জানিয়েছে, ১৩ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত সংক্রমণ বেড়েছে ৩৯ শতাংশ এবং ২৭ জুন নাগাদ এক সপ্তাহে বেড়েছে ২৫ শতাংশ। জাম্বিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্রসহ অন্তত ২০টি দেশে চলছে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ। দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
টিকা সরবরাহে কচ্ছপ গতি:
কোভ্যাক্স টিকার অন্যতম প্রধান উৎস হলো যুক্তরাজ্যের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা। ২০২০ সালের জুনে সংস্থাটি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে, ২০২০ সালের মধ্যে ৪০ কোটি টিকা সরবরাহ করার কথা ছিল সেরামের।
কিন্তু, মার্চে ভারতে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারিতে দেশের চাহিদা মেটানোর জন্য সেরামকে টিকা রপ্তানি বন্ধের নির্দেশ দেয় সরকার। এর ফলে বড় ধাক্কা খায় কোভ্যাক্স কর্মসূচি।
চলতি বছরের মার্চ মাসের শেষদিকে কোভ্যাক্স মাত্র ২ কোটি ৮০ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দিতে পেরেছে। এপ্রিলের শেষদিকে আরও ৯ কোটি টিকা পাওয়ার কথা ছিল। সেগুলো এখনও আটকে আছে।
ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আফ্রিকার দেশগুলো কোভ্যাক্সের মাধ্যমে সবমিলিয়ে মাত্র ১ কোটি ৮২ লাখ টিকা পেয়েছে। অথচ পাওয়ার কথা ছিল ৬ কোটি ৬০ লক্ষ ডোজ।
আফ্রিকার মোট জনসংখ্যা ১৩০ কোটি। তাদের মাত্র ২ শতাংশ কোভিড টিকার এক ডোজ পেয়েছে। সম্পূর্ণ বা দুই ডোজ টিকা পেয়েছে এক শতাংশের কিছু বেশি, ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ।
সেরাম ইন্সটিটিউটের এক মুখপাত্র নেচার-কে জানিয়েছেন, ২০২১-এর শেষদিকে প্রতিষ্ঠানটি ফের বিশ্বব্যাপী টিকা রপ্তানি শুরু করতে পারবে বলে আশা করছে। কোভ্যাক্সের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বিলম্ব সত্ত্বেও বছরের শেষ নাগাদ সংস্থাটি ২০০ কোটি ডোজ টিকা সবরাহ করতে পারবে বলে আশাবাদী।
এদিকে আফ্রিকান ইউনিয়ন টিকার বিকল্প উৎসের সন্ধান করছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সংস্থাটি জনসন অ্যান্ড জনসনের ৪০ কোটি ডোজ এক ডোজের টিকা কিনেছে।
আফ্রিকার দেশগুলো নিজেরাও আলাদাভাবে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, ধনী দেশের তুলনায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা কম বলে এই গরিব দেশসমূহ টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকার তালিকায় একেবারে তলানির দিকে আছে।
টিকা দরকার এখনই:
ভারতের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেওয়ার পর, আমেরিকাই এখন নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে প্রধান টিকা সরবরাহকারী। দেশটি এখন নিজেদের মজুদকৃত বাড়তি টিকার কিছু কিছু বিভিন্ন দেশে বিতরণ শুরু করেছে।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথনের মতে, এই গতিতে টিকা বিতরণ চলতে থাকলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। টিকা বিতরণের এই ধীরগতির কারণেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থামছে না। করোনার নতুন ধরনগুলোর—বিশেষত ডেল্টা ধরনের কারণে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে টিকা না নেওয়া লোকেরা। সৌম্য স্বামীনাথন বলেছেন, বাড়তি টিকার মজুত থাকা দেশগুলোর কাছ থেকে সেপ্টেম্বরে মধ্যে ২৫ কোটি টিকার অনুদান প্রয়োজন।
সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিটা দেশের অন্তত ১০ এবং বছরের শেষ নাগাদ ৩০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনার জন্য সদস্য দেশগুলোর সহায়তা চেয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ধনী দেশগুলো যদি কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে টিকা দেয় এবং টিকা উৎপাদকরা যদি কোভ্যাক্সের ক্রয়াদেশকে অগ্রাধিকার দেয়, তবেই কেবল এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব।
তবে 'সময়' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ছয় মাস পরে টিকা পেলে যে উপকার হবে, এখন পেলে সুফল পাওয়া যাবে তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি।
- সূত্র: নেচার ডটকম