বিশ্ব বাজারে চিংড়ির রপ্তানি হারাচ্ছে বাংলাদেশ
বিশ্ব বাজারে চিংড়ির চাহিদা বাড়লেও এ খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। কেননা ভেন্নামি শ্রিম্প বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ির তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা কমছে।
২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ বছরে চিংড়ির বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের দখল ৪ শতাংশ কমে ২ শতাংশে নেমেছে। আর এ সময় ধারাবাহিকভাবে চিংড়ি রপ্তানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। আর এ সময় চিংড়ির উৎপাদনও ২৮.৩৫ শতাংশ কমে গেছে।
এ কারণে বাজারে তালিকাভুক্ত চিংড়ি রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দরও পড়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব বাজারে এক সময় রাজত্ব করা বাগদা ও গলদা চিংড়ির বাজার দখল করে নিয়েছে ‘ভেন্নামি শ্রিম্প’ বা প্যাসিফিক হোয়াইট-লেগড শ্রিম্প (প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি)। উচ্চ ফলনশীল এবং দাম কম হওয়ায় হাইব্রিড জাতের এ চিংড়ি চাষ করে ইতোমধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। তবে বাংলাদেশে এ চিংড়ি চাষের এখনও অনুমতি দেয়নি সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, হাইব্রিড জাতের এই সাদা চিংড়ি উচ্চ ফলনশীল এবং দামেও খুব সস্তা। চিংড়ি রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলো এই চিংড়ি উৎপাদন করে অনেক এগিয়েছে। সেখানে আমরা উচ্চ মূল্যের বাগদা চিংড়ি নিয়ে আছি। আবার গলদা-বাগদার চাহিদা কমতে থাকায় ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এ খাতের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের মোট চিংড়ি রপ্তানির ৭৭ শতাংশই এখন ভেন্নামির দখলে। আর বাগদা চিংড়ির দখলে মাত্র ১১ শতাংশ। বর্তমানে ভেন্নামি চিংড়ির চেয়ে বাগদা চিংড়ির দাম পাউন্ডপ্রতি ২ ডলার বেশি। বৈশ্বিক অর্থনীতির স্লথ গতির কারণে ক্রেতারা খরচ কমানো শুরু করেছেন। আর তাই আমাদের চিংড়ির চাহিদা আরও কমছে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি বাড়াতে অনেক দিন ধরে আমরা ভেন্নামি চিংড়ি চাষের কথা বলছি। তবে এত দিন সরকার অনুমতি দেয়নি। ২০ বছর ধরে চেষ্টা–তদবিরের পর অবশেষে পরীক্ষামূলকভাবে চাষের অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে অধিদপ্তর শুধু রপ্তানিকারকদের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু রপ্তানিকারকদের চাষের অভিজ্ঞতা নেই। আবার অনুমতি দিয়েছেন এক বছরের। এই সময়ের মধ্যে পরীক্ষামূলক চাষ সফল না–ও হতে পারে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ করতে হবে ব্যবসায়ীদের।
ভেন্নামি চিংড়ি চাষে সফলতা পেতেও প্রায় পাঁচ বছর লেগে যাবে বলে মনে করেন কাজী বেলায়েত হোসেন।
রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ হিসাব বছরে বাংলাদেশ মোট ৫৪৫ মিলিয়ন ডলারের ৪১,২৩৬ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করে।
এরপর থেকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে চিংড়ির বাজার হারাতে থাকে। সেই সাথে উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থ বছর থেকে চিংড়ি রপ্তানি ৩৪ শতাংশ কমে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে হয়েছে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। সে বছরে ২৯ হাজার ৫৪৩ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল।
চলতি বছরেও চিংড়ি রপ্তানিতে পতন অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে চিংড়ি রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ শতাংশ কমেছে। এ সময় ১৭৭ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। আগের বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১৮৯ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল।
বর্তমানে দেশে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫০৯ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি চিংড়ি রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া ইউএসএ, রাশিয়া এবং জাপানেও চিংড়ি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্ব বাজারে চিংড়ির চাহিদা বাড়ছে। ২০১৪ সালে ৪৩ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ির চাহিদা ছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চিংড়ির চাহিদা বেড়ে হয়েছে ৪৮ লাখ মেট্রিক টন।
ভেন্নামি বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় সাদা চিংড়ি কি
১৯৭০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্যিকভাবে এই চিংড়ি চাষ শুরু হয়। তারপর একে একে চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে এর চাষ ছড়িয়ে পড়ে।
যদিও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাইরের অজানা রোগ ছড়িয়ে পরার ভয়ে অনেক দেশই এই চিংড়ির চাষ করতে চায়নি।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বাংলাদেশের এক হেক্টর জমিতে তিনশ থেকে চারশ কেজি গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষ হয়। অথচ এই একই এলাকায় আরও কয়েকগুণ বেশি
ভেন্নামি চিংড়ি চাষ করা সম্ভব।
দেশের শীর্ষ চিংড়ি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান
চিংড়ি রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুডস। হিমায়িত খাদ্যের শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে কোম্পানিটি ২০১১-১২ এবং ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে জাতীয় রপ্তানিতে স্বর্ণ পদক পেয়েছিল।
কিন্তু বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০১৩-১৪ হিসাব বছর থেকে ব্যবসা হারাতে থাকে কোম্পানিটি। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছর পর্যন্ত কোম্পানিটির চিংড়ি রপ্তানি ৩৮৪.৪৬ কোটি টাকা থেকে ৫৫.৪৫ শতাংশ কমে ১৭১.২৬ কোটি টাকা হয়েছে।
তবে ব্যবসা কমলেও কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের গত পাঁচ হিসাব বছর ধরে ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
চলতি হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটির রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪.৪০ কোটি টাকা থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়ে ৬০ কোটি টাকা হয়েছে। তবে এ সময় উৎপাদন খরচ ৩৮ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় নেট মুনাফা ২৫ শতাংশ কমেছে।
এদিকে ব্যবসা কমে যাওয়ার প্রভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ার দর ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে এপেক্স ফুডসের শেয়ার দর সর্বোচ্চ ২৭২.৩০ টাকা ছিল। অথচ সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ১২৩.৩০ টাকা।
এপেক্স ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৩-১৪ অর্থ বছর পর্যন্ত আমাদের একটি ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ছিল। কিন্তু বিশ্ব বাজারে আমাদের চিংড়ির চাহিদা ও দাম কমে যাওয়ায় আগের মতো উৎপাদন বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে একটি টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমরা চেষ্টা করছি।
চিংড়ি রপ্তানিতে জেমিনি সি ফুড লিমিটেড কখনোই ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। ২০১২ সালের পর থেকে কোম্পানিটির রপ্তানি পরের চার বছর ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এরপর ২০১৭ সালে কোম্পানিটির রপ্তানি হঠাৎ বেড়ে হয়েছিল ১৩৫ কোটি টাকা। সে বছর তারা শেয়ারহোল্ডারদের ১২৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছিল। আর এই এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৩০০ টাকা থেকে ৩৯৫ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৪৮৫ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল।
২০১৭ সালের পর থেকে কোম্পানিটির চিংড়ি রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৮-১৯ হিসাব বছর পর্যন্ত কোম্পানিটির রফতানি ৫০.৪৩ শতাংশ কমে হয়েছে ৬৭.১৬ কোটি টাকা।
এর সঙ্গে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেও কোম্পানিটির শেয়ার দর ধারাবাহিকভাবে কমেছে। সোমবার কোম্পানিটির শেয়ারের সমাপনি দর ছিল ১৭১.৭০ টাকা।
ব্যবসা কমে যাওয়া নিয়ে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ইনাম আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভেন্নামি চিংড়ির জন্য আমাদের দেশে উৎপাদিত চিংড়ির চাহিদা কমেছে। আমরা উৎপাদন খরচ কমিয়ে আরও ভালো মানের চিংড়ি উৎপাদনের জন্য কাজ করছি।
তিনি আরও বলেন, চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মান বাড়াতে কারখানা আধুনিকায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর জন্য ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে।
(https://tbsnews.net/economy/trade/bangladesh-loses-export-market-whiteleg-shrimp-35693)