টিকা: চীনের বিরুদ্ধে জাপানের নতুন অস্ত্র
এ মাসের শুরুর দিকে টোকিওতে জরুরি অবস্থা জারি করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা। ২২ আগস্ট পর্যন্ত বলবত থাকবে এ জরুরি অবস্থা। ফলে দর্শকরা স্টেডিয়ামে বসে অলিম্পিক গেমস দেখার সুযোগ পাবেন না।
টোকিওতে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এবং টিকাদানের হার কম বলে এ ব্যবস্থা নিয়েছেন সুগা।
জাপানের মাত্র ২৩ শতাংশ মানুষ পূর্ণ ডোজ টিকার আওতায় এসেছেন, যা জি-৭ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
দেশের ভেতরে মহামারি পরিস্থিতি খারাপের দিকে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও টিকা কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে জাপান। এর কারণ দুটো—দাতা হিসেবে নাম কুড়ানো এবং চীনের টিকা কূটনীতি হোঁচট খাওয়া।
গত ১৬ জুন জাপান স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ২ মিলিয়ন ডোজ টিকা ভিয়েতনামে পাঠায়। এর এক সপ্তাহ পর দেশটি তাইওয়ান ও ভিয়েতনামকে বাড়তি ২ মিলিয়ন ডোজ করে এবং থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনকে ১ মিলিয়ন ডোজ করে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ভারতকে ১৪.৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চিকিৎসা সামগ্রী দিয়েছে জাপান। এছাড়াও দেশটি জাতিসংঘ শিশু তহবিলে ৩৯ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কোভিড সংকট মোকাবিলার জন্য জরুরি ঋণ সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে জাপান।
জাপানের টিকা কূটনীতি রাশিয়া বা চীনের মতো ব্যাপক মনোযোগ কাড়তে না পারলেও টোকিওর টিকা বিতরণ ও চিকিৎসা সহায়তা সুদূরপ্রসারী ভূরাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে। জাপানের জনস্বাস্থ্য সহায়তা মডেল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এর ফলে ভারত ও সাব-সাহারান আফ্রিকার সঙ্গে জাপানের অংশীদারত্বের সম্পর্ক আরও জোরাল হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এসব অঞ্চলে জাপানের শাসনপদ্ধতির—ব্যক্তি পর্যায়ের দায়িত্বশীলতাকে পুরস্কৃত করা এবং সীমিত সরকারি হস্তক্ষেপ—আবেদন বাড়তে পারে। এই ট্রেন্ড সম্ভবত মহামারির পরও জারি থাকবে। ফলে আগামী দশকে চীন ও জাপানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র রূপ নেবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানের টিকা প্রদানের ঘোষণার ফলে এই অঞ্চলে চীনের টিকা কূটনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়েছে। চীনের সিনোভ্যাক টিকার কার্যকারিতা আমেরিকান টিকার তুলনায় অনেক কম। এছাড়া ইন্দোনেশিয়াকে টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কেন্দ্র করে বেইজিং যে 'হেলথ সিল্ক রোড'-এর পরিকল্পনা নিয়েছিল, এ বছরের প্রথমার্ধে সেটিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। যতটা আশা করা হয়েছিল, তার মাত্র অর্ধেক পরিমাণ সিনোভ্যাক উৎপন্ন করতে পেরেছে দেশটি। ফলে কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহ করা যায়নি।
ইন্দোনেশিয়ায় পূর্ণ ডোজ সিনোভ্যাক নেওয়া ১০ জন ডাক্তার মারা গেছেন। ফলে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনে উৎপাদিত টিকার ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস কমে গেছে। ট্রায়ালের আগেই অননুমোদিত সিনোফার্ম গ্রহণের জন্য ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে ক্ষমা চেয়েছেন।
চীনা টিকার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে গঠিত কোয়াড ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে টিকা রপ্তানির পরিকল্পনা নেয়। গত মার্চের বৈঠকে ২০২২ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে ১ বিলিয়ন ডোজ টিকা সরবরাহে একমত হয় চার দেশ। ২০২১-এর শুরুর দিকে কোয়াডের প্রধান টিকা সরবরাহকারী ছিল ভারত। কিন্তু দেশটিতে কোভিড সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় তার জায়গা নেয় জাপান।
কোয়াডকে টিকার ন্যায্য ও অরাজনৈতিক বিতরণে উৎসাহ দেয় জাপান। কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর বন্ধু কিংবা অংশীদার সব রাষ্ট্রেই টিকার 'ন্যায্য বণ্টনে'র নীতিকে সমর্থন দেয় দেশটি। জাপানের প্রস্তাব কোয়াডে সাদরে গৃহীত হয়। যদিও বাইডেন প্রশাসন প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোতেই টিকা পাঠিয়েছে।
চীন ও জাপানের টিকা কূটনীতির লক্ষ্যবস্তু বেশিরভাগ সময় একই দেশ হয়। ফলে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বিতাও বেড়ে যায় সমান তালে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি—যেমন থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনের সঙ্গে বিদ্যমান সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে চীনা নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক বলয়ে এসব দেশের প্রবেশ ঠেকিয়ে রেখেছে জাপান।
এছাড়াও জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের 'মানসম্পন্ন অবকাঠামো' প্রকল্পও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকে কোণঠাসা করে রেখেছে। চীনা টিকার মান নিয়ে যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কার খাতেও চীনের উৎপাদন মান ও দক্ষতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সন্দেহের মুখে পড়বে। এর ফলে লাভবান হবে জাপানি নির্মাণ সংস্থাগুলো।
টিকা বিতরণের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে জাপানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে টোকিওর বন্ধুত্ব আগের চেয়ে দৃঢ় ও টেকসই হয়েছে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশই জাপানকে সংকট মোকাবিলার জন্য নির্ভরযোগ্য মিত্র বলে বিবেচনা করে।
জাপানের টিকা বিতরণ এখনও পর্যন্ত মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই চলছে। তবে চিকিৎসা সামগ্রী দেওয়ার বদৌলতে ভারতের সঙ্গে দেশটির বন্ধন আরও দৃঢ় হবে, আফ্রিকার কাছেও উজ্জ্বল হবে ভাবমূর্তি।
জাপান ও ভারতের মধ্যকার উন্নয়ন সহযোগিতার ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৫৮ সালে প্রথম দেশ হিসেবে জাপানের আনুষ্ঠানিক সহায়তা গ্রহণ করে ভারত এবং ২০০৪ সালে দেশটির বৃহত্তম সাহায্যগ্রহীতায় পরিণত হয়। জাপানের সঙ্গে ভারতের এই সুসম্পর্ক অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পশ্চিমা দেশগুলো যখন চীনা ওষুধপণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে চাচ্ছে, জাপান ও ভারত তখন একসঙ্গে একটি সাপ্লাই চেইন তৈরির পরিকল্পনা করছে। জনস্বাস্থ্য খাতে জাপান-ভারতের সহযোগিতা বাড়লে কোয়াড ব্লকও শক্তিশালী হবে। এ কারণে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষায়ও একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছে টোকিও-নয়া দিল্লি।
এদিকে, আফ্রিকার কোভিড মহামারিতে পশ্চিমা দেশগুলোর বিলম্বে সাড়া দেওয়ার সুযোগ নিয়েছিল চীন। চীনের এই টিকা কূটনীতি গোটা আফ্রিকা মহাদেশে সাড়া ফেলেছে। তবে করোনাকালে মহাদেশটিতে সবসময় চীনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আফ্রিকার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সেশেলস টিকার জন্য প্রথমে ব্যাপকভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও পরে তাদের আস্থায় ফাটল ধরে।
আফ্রিকায় পা রাখছে জাপান। দেশটি আফ্রিকান ইউনিয়নের জয়েন্ট কন্টিনেন্টাল স্ট্র্যাটেজির আওতায় আফ্রিকার জন্য ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে। এছাড়াও ১ লক্ষ ২০ হাজার আফ্রিকান স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য খাতে জাপানের বিনিয়োগ এশিয়া-আফ্রিকা গ্রোথ করিডরকেও—জাপান, ভারত ও বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের চুক্তি—শক্তিশালী করেছে। এ চুক্তির উদ্দেশ্য উন্নয়ন সহযোগিতার জন্য আফ্রিকার দেশগুলোর চীন-নির্ভরতা কমানো। কেনিয়া ও জাম্বিয়ার মতো আফ্রিকান দেশগুলো চীনের পাহাড়সম ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কোভিডকালে জাপানের নিঃশর্ত কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারটি মহাদেশজুড়ে সমাদৃত হতে পারে।
জাপানের শাসন মডেলের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা কূটনীতির আবেদনও বাড়ছে। জি-৭-ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জাপানে করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম। দেশটি এই সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জোরেশোরে প্রচার করেছে। জাপান মডেলে করোনা মোকাবিলায় ব্যক্তি পর্যায়ে দায়িত্ব নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ মডেলে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মতো ব্যক্তিগত পদক্ষেপগুলোকে বেশি উৎসাহ জোগানো হয় এবং লকডাউনের মতো সরকারি পদক্ষেপ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা হয়।
জাপান মডেলের বৈশ্বিক দূত হলেন প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট হিতোশি ওশিতানি। তিনি নিয়মিত জাপান মডেলে উল্লিখিত তিনটি 'সি' (C)-কে এড়িয়ে যাবার কথা বলে গেছেন বিভিন্ন বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে। তিন 'সি' হলো—জনসমাগম (crowd), বদ্ধ জায়গা (close spaces) এবং ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ (close-contact)। শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার মতো দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে এ মডেল ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে।
মহামারিকালে জাপান যেখানে সহনশীলতার মডেল অনুসরণ করেছে, চীন সেখানে অবলম্বন করেছে কঠোর লকডাউন মডেল। মহামারি মোকাবিলায় এই ভিন্ন পথ অবলম্বন আন্তর্জাতিক শাসন নীতিতেও দুই দেশের বিরোধকে তীব্র করে তুলেছে।
জাপান মডেলের মূলনীতি হচ্ছে নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা হাত ধরাধরি করে চলতে পারে। কিন্তু চীনের নীতি উল্টো—নিরাপত্তার জন্য স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে তারা। প্রাথমিক পর্যায়ে চীনের মহামারি মোকাবিলার পদ্ধতি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়ালেও পরবর্তীকালে কোভিড-১৯-এর প্রতি চীনের অস্বচ্ছ সাড়া ও ভাইরাসটির উৎপত্তি নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা এই সাফল্যে কলঙ্কের ছোপ লাগিয়েছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক দাতা হিসেবে সুনামকে জাপান দক্ষ হাতে মহামারি মোকাবিলার মাধ্যমে আরও দৃঢ় করেছে। সেইসঙ্গে চীনের দুর্নামকে পুঁজি করে দেশটি বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে নিজের সুনাম বাড়িয়ে নিয়েছে।
জাপানের কম টিকা দেওয়ার হার এবং টোকিও অলিম্পিকের ঠিক আগে আগে করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও মহামারিকালে দেশটি চিকিৎসা কূটনীতিতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। চীনের টিকা কূটনীতির হোঁচট খাওয়া এবং সফট পাওয়ার কমে যাওয়ার সুবাদে জাপানের টিকা ও চিকিৎসা সহায়তা দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে জাপানের অংশীদারত্ব, প্রভাব ও সম্মান বাড়াবে নিঃসন্দেহে। সেইসঙ্গে বাড়বে জাপান মডেলের সমাদরও।
-
সূত্র: ফরেন পলিসি