শরণার্থী লুনার অলিম্পিক যাত্রার গল্প
স্বপ্ন কে না দেখে! স্বপ্ন দেখার পথে বাধা নেই, কল্পনার রাজ্যে চাইলে মুহূর্তেই হয়ে ওঠা যায় নিজের মনের মতো। হোক না সেটা এক মুহূর্তের জন্য। স্বপ্ন স্বাধীন, স্বপ্ন ডানা মেলে ওড়ে। এই স্বপ্ন আর স্বাধীনতাই ডাকছিল লুনা সলোমনকে। তাই তো পথটা কেমন হবে, তা না ভেবেই আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া থেকে পালিয়ে পাড়ি জমান সুইজারল্যান্ডে।
ইউরোপের রঙিন জীবনের স্বপ্ন এঁকে সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েন লুনা। গায়ে এঁটে যায় শরণার্থীর সিল। যা তাকে মানসিকভাবে আরও পিছিয়ে দেয়, ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকেন মুখ তুলে কথা বলতে না পারার যন্ত্রণায়। তবু লুনা আলোর পথে ছোটেন, ঠিকই খুঁজে নেন নিজের গন্তব্য। যে গন্তব্যে শরণার্থী শিবির থেকে টোকিও অলিম্পিক!
'শরণার্থী' লুনা টোকিও অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। আলো ঝলমলে হয়নি তার এই অধ্যায়। আসাকা শুটিং রেঞ্জে মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের বাছাইয়ে ৫০তম হন। বাছাই থেকেই বিদায় ছিটকে গেছেন তিনি। তার মহাকাব্যিক পথচলা তো শুধু এই বাছাইয়েই আটকে থাকার নয়। তার গল্প সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। তার গল্প ভয়, শঙ্কাকে জয় করার।
লুনার এই পথচলায় একটি নাম খুব বড় করে; অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণজয়ী শুটার নিক্কোলো কামপিরিয়ানি। এই মানুষটির সঙ্গে দেখা না হলে তাকে শরণার্থী পরিচয়েই হয়তো বাকি জীবন পার করে দিতে হতো। ২০১৫ সালে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে লুনাকে খুঁজে পান কামপিরিয়ানি, খুঁজে পান লুনার মাঝে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা।
রিও অলিম্পিকের পর শুটিংকে বিদায় বলে সুইজারল্যান্ডে স্থায়ী হন কামপিরিয়ানি। লুজানের শরণার্থীদের মধ্য থেকে মেধাবী শুটারদের খুঁজে বের করার কাজ শুরু করেন তিনি। অলিম্পিক চ্যানেল অরিজিনাল সিরিজ 'টেকিং রিফিউজি'- এর কাজ করতে গিয়ে লুনার সঙ্গে দেখা হয় কামপিরিয়ানির। এরপর লুনাকে শুটিংয়ে আনেন সাবেক ইতালিয়ান এই শুটার।
শুটিংয়ে নাম লিখিয়ে বদলে যেতে থাকেন লুনা। দেখা মেলে আত্মবিশ্বাসী এক নারীর, মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শেখেন তিনি। পা ফেলতে শুরু করেন নতুন স্বপ্নের পথে। লুনার ভাষায়, 'শুটিংয়ে যোগ দেওয়ার পর মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলার আত্মবিশ্বাস পাই আমি। যা আমি আগে কখনও করতে পারতাম না। মাথা নিচু রাখতেই অভ্যস্ত ছিলাম; কারণ আমি ছিলাম শরণার্থী।'
খেলাধুলার কারণেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছেন বলে বিশ্বাস করেন লুনা। এ কারণে খেলাধুলার প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতা। ২৭ বছর বয়সী লুনা অলিম্পিক ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমি খেলাধুলার প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন লুনা অন্য সবার মতোই, ঘাটতির জায়গা নেই। খেলাধুলায় এসে আমি আত্মবিশ্বাস পেয়েছি।'
জীবন যুদ্ধের এই সাহসী সৈনিক বিবাহিত, তার সন্তান আছে। ফেলে আসা কঠিন পথের কথা মনে করে লুনা বলেন, 'আপনি জীবনে কখনও পথ বেছে নিতে পারবেন, আবার কখনও পারবেন না। আমি পেরেছিলাম, যদিও জন্মভূমিতে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। তবে পরিস্থিতি নিরাপদ ছিল না। এ কারণেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি ছিলাম প্রচন্ড হতাশ ও একজন দুঃখী মেয়ে।'
আলোর পথ পাওয়া লুনা এখনও ইরিত্রিয়াতে ফেরেননি। তবে তার আশা কোনো একদিন জন্মভূমিতে ঠিক ফিরবেন। লুনা বলেন, 'আমার পথ সহজ ছিল না। ইরিত্রিয়ার জীবনযাত্রায় স্বাধীনতা না থাকার কারণে দেশ ছেড়েছিলাম। কিন্তু আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, মনে পড়ে। আশা করি একদিন নিজ দেশে ফিরব। আমি এখন সুইজারল্যান্ডের লুজানের অলিম্পিক সিটিতে আছি।'
টোকিও অলিম্পিকে পারেননি, আগামীতে পারবেন; এই বিশ্বাস আছে লুনার মনে। তাই এখনই পরের অলিম্পিকে নজর তার, 'আমি ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক পর্যন্ত খেলাধুলার সঙ্গে থাকব। ওই অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে চাই আমি।'
লুনার নতুন জীবনের অংশ হতে পেরে তৃপ্ত কামপিরিয়ানি। তাকে পথ দেখাতে পেরে গর্বিত কিংবদন্তি এই শুটার। লুনা প্রতিনিয়তই উন্নতি করছে, এটা দেখে বিস্মিত হন না কামপিরিয়ানি; বরং তিনিও স্বপ্ন দেখেন শিষ্যের চোখ দিয়ে। তার ভাষায়, 'লুনা প্রতিনিয়তই আরও উন্নতি করছে, এটা দেখে আমি বিস্মিত নই। খুঁজে পাওয়া জীবনের ভারসাম্য সে শুটিংয়েও মিলিয়ে নিয়েছে।'