বাইরে জৌলুস, ভেতরে নেই উন্নত চিকিৎসাসেবা ২৫০ শয্যার হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে
শুক্রবার বিকেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে পারভীন আক্তার চৌধুরীকে (৫৯) তার স্বামী নিয়ে গিয়েছিলেন ২৫০ শয্যার হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। অনেক চেষ্টা তদবির করে স্বজনরা অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১০ মিনিট যেতে না যেতেই রহমত মিয়া নামে আরেক রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে পারভীনের নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে ওই রোগীকে দেওয়া হয়। অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয়ায় এই চিত্র এখন প্রতিদিনের।
শুধু অক্সিজেনই নয়, চিকিৎসক ও অন্যান্য সরঞ্জামের অভাবে কর্মরত চিকিৎসক এবং নার্সরা নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর স্বজনদের গালিগালাজ পর্যন্ত হজম করতে হচ্ছে তাদেরকে।
প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার নান্দনিক হাসপাতাল। বাইরে জৌলুসে ভরপুর। কিন্তু ভেতরে চিকিৎসা নেই বললেই চলে। কাগজে-কলমে আধুনিক হাসপাতাল বলা হলেও বাস্তবে উন্নত চিকিৎসার কোন আলামত দেখা যায় না। প্রায় ২২ লাখ মানুষের এই জেলায় চিকিৎসার জন্য এখনো দৌড়াতে হয় ঢাকা কিংবা সিলেটে।
জেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ১০০ শয্যার হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। ৮ তলা ভবনটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের জনবলের অনুমোদন দেয়া হয় এই বছরের ৯ জুন। সে হিসেবে হাসপাতালে মোট আরো ২০ জন ডাক্তার ও অন্যান্য পদে ৩৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু এখনো পদগুলো পূরণ করা হয়নি।
এর আগে মে মাসের তালিকানুযায়ী হাসপাতালের অনুমোদিত ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য পদের বিপরীতে কর্মরত ও শূন্যপদ হিসাব করলে দেখা যায়, ৪০টি ডাক্তারের পদে ২৪ জন, নার্সের ১৪১ পদের মধ্যে ৮৭ জন কর্মরত আছেন। নাক-কান-গলা, চক্ষু বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট, জুনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু, এ্যানেস্থেশিস্ট, প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, ৬ জন মেডিকেল অফিসার, ২ জন ইএমও, ২ জন মেডিকেল অফিসার (রক্ত), হেলথ এডুকেশন অফিসার পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া সিনিয়র স্টাফ নার্স ৩৯ জন, স্টাফ নার্স ৬ জন, সহকারী নার্স ৩ জন, ২ জন ফার্মাসিস্ট, দন্ত, ল্যাব, রেডিওলজি, ফিজিওলজি, ইপিআই, ইসিজি, এ্যানেস্থেশিয়া, ডায়ালাইসিস, বায়োমেডিকেল ও ইকো বিভাগের ২১টি টেকনোলিজিস্টের পদ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে ২৭টি পদ শূন্য রয়েছে। উল্লেখ্য যে, কর্মরত ৮ জন মেডিকেল অফিসারের মধ্যে ২ জন হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে সংযুক্ত আছেন। এছাড়া মেডিকেল অফিসার (আয়ুর্বেদ) প্রেষনে নরসিংদী হাসপাতালে রয়েছেন। বাস্তবে হাসপাতালে ২১ জন চিকিৎসক কর্মরত রয়েছেন।
প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ভবন নির্মিত হলেও বাস্তবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাপক কোন পরিবর্তন হয়নি। করোনার এই মহামারিতে এখনও বেডের অভাবে পুরনো ভবনে রোগীদেরকে গাদাগাদি করে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। সুষ্ঠু তদারকির অভাবে বাথরুম ও টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
৮ তলা ভবনের ২য় ও ৩য় তলা হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস হিসেবে গত ২০১৬ সাল থেকে চালু রয়েছে । এই দুইতলা হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ড হিসেবে নির্ধারিত ছিল। ৫ম তলায় শিশু, ৬ ও ৭ তলা করোনা ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নীচতলাটি করোনা টিকা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি তলাগুলো অব্যবহৃত রয়েছে। করোনার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট এখনো পুরোপুরিভাবে চালু হয়নি।
আরএমও ডাঃ মোমিন উদ্দিন চৌধুরী জানান, ৩০ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে করোনার ৫০ জন করোনা পজেটিভ ও ২৫ জন আইসোলেশনে ছিলেন। নতুন ডিজিটাল এক্সরে মেশিন স্থাপন করা হলেও ফিল্ম এর অভাবে এর কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে।
হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা হাসপাতালে থাকলেও অপারেটিং সিস্টেম কারোর জানা না থাকায় তা ব্যবহার যাচ্ছেনা। সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু আছে। তবে যেখানে ৬০/৭০ লিটার চাহিদা সেখানে মাত্র ১০ লিটার অক্সিজেন পর্যন্ত দেয়া সম্ভব। সিলিন্ডার রিফিল করার জন্য সিলেট পাঠানো হয়। সিলেট থেকে তা মানিকগঞ্জ বা চাঁদপুর পাঠানো হয়। অক্সিজেন ভরে সিলেট আসে। তারপর হবিগঞ্জ প্রেরণ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যেভাবে রোগীদের অক্সিজেনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে হয়তো কিছুদিনের মধ্যে রোগীদেরকে আর অক্সিজেন দেয়া সম্ভব হবে না।
হাসপাতালের সদ্য বদলি হওয়া তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ হেলাল উদ্দিন জানান, এক্সরে মেশিনের সাথে ৫০০টি ফিল্ম দেয়া হয়। বর্তমানে ২০০টি ফিল্ম রাখা হয়েছে বিশেষ রোগীদের জন্য। পরবর্তী বছরে টেন্ডারের মাধ্যমে এক্সরে ফিল্ম ক্রয় করা হবে। ফলে সাধারণ রোগীদেরকে বাইরে থেকে এক্সরে করতে হচ্ছে। দুটি পুরনো এনালগ মেশিন মেরামত না করায় তা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
এদিকে গত বছরের মার্চ মাসে আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি অকেজো হয়ে যাওয়ায় রোগীদের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। গত বছরের মে মাসে হাসপাতাল রোগী কল্যাণ কমিটির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এমপি এ সংক্রান্ত একটি ডিও দেয়ার পরেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন আলট্রা মেশিন সরবরাহ করেনি। অপরদিকে হাসপাতালের নতুন ভবনের লিফট নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়ায় রোগী ও চিকিৎসকদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াহিদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, লিফটটি ৬ তলার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আরো ২ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়। কারিগরী দিক দিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় মাঝে মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একজন লিফটম্যান নিয়োগ করার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু এখনও নিয়োগ দেয়া হয়নি।
হবিগঞ্জ এডভোকেট সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহুল হাসান শরীফ বলেন, "করোনার এই মুহুর্তে ওষুধের পাশাপাশি রোগীর জন্য অক্সিজেন খুবই জরুরী। হবিগঞ্জ আধুনিক হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু খবরও পাচ্ছি। যা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায়না। হাসপাতালের বাইরে আলোকসজ্জায় লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। তা যদি চিকিৎসা সামগ্রী খাতে ব্যয় হতো তা হলে হয়তো রোগীরা মৃত্যুর আগে একটু চিকিৎসা পেতেন"।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) হবিগঞ্জ শাখার সভাপতি এডভোকেট ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, "এই হাসপাতালটিতে মূলত কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা। চিকিৎসকরা আছেন শুধু ঢাকা বা সিলেট মেডিকেল হাসপাতালে রেফার করার জন্য। অক্সিজেনসহ চিকিৎসার সরঞ্জামাদির যে সংকট রয়েছে এতে হাসপাতাল থাকা না থাকা এক সমান। চিকিৎসক শুধু থাকলেই হবে না তারা কতটুকু চিকিৎসা দিতে পারেন তা দেখতে হবে"। সাজসজ্জার চেয়ে চিকিৎসা খাতে অর্থ ব্যয় বাড়ানোর জন্য দাবি জানান তিনি।
যোগাযোগ করা হলে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "স্পেকট্রা নামক একটি প্রতিষ্ঠান সারাদেশে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের সব হাসপাতালে অক্সিজেন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারছেনা। এছাড়া লিন্ডে নামে একটি অপর একটি প্রতিষ্ঠান তরল অক্সিজেন সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন প্রকৌশলী ঈদের পর হবিগঞ্জে ট্যাঙ্ক বসানোর কাজ শুরু হবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও কাজ শুরু করেননি"।
তিনি জানান, "হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা চালু করতে সিলিন্ডার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। অক্সিজেন সরবরাহ কম এবং তা চালনা করতে যে দক্ষ জনবল প্রয়োজন তা এখানে নেই। ফলে এটি তা চালু করা যাচ্ছেনা"। তবে তিনি আশা করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খুব শীঘ্রই সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।