কাঁচামালে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় নজর স্থানীয় ওষুধ শিল্পের
- দেশে ওষুধের বাজার ২৭ হাজার কোটি টাকার
- ৯৮% স্থানীয় কোম্পানির দখলে
- ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি ১৫০০ কোটি টাকা
- ৯৭% কাঁচামালই আমদানি আমদানি করতে হয় বিভিন্ন দেশ থেকে
- এলডিসি সুবিধা এখনো রয়্যালিটি সুবিধায় আসে কাঁচামাল
- বছরে লাগে আমদানি ৫০০০ কোটি টাকার কাঁচামাল
- মুন্সীগঞ্জে ২০০ একর জমিতে হচ্ছে API শিল্প পার্ক
- ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ২৭ কোম্পানির
- ৪২টি প্লটে কারখানা স্থাপনের কাজ চলমান
- অন্তত ৩০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে
- একাই ৩ প্লটে বৃহৎ কারখানা করছে স্কয়ার
- ২০২২ সালের জুনে উৎপাদন শুরু করবে একমি
ওষুধ উৎপাদনে বিন্দু থেকে মহীসোপানে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর শত কোটি টাকা থেকে বর্তমানে ২৭ হাজার কোটি টাকায় দেশের ওষুধ শিল্প। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানিও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ডব্লিউটিওর দেয়া প্যাটেন্ট সুবিধায় ওষুধ উৎপাদনের আকাশ ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখন শুধু ওষুধ উৎপাদনই নয় ওষুধের ইনগ্রেডিয়েন্ট উদ্ভাবনে নিজেদের শক্তি জানান দিতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় এপিআই পার্কে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে ৫-৬টি কোম্পানি। বিনিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছে প্রথম সারির দুই ডজনের বেশি কোম্পানি।
ওষুধ শিল্প পার্কের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, ২৭টি কোম্পানি কারখানার স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দ নিয়েছে। সরকারি অবকাঠামো ছাড়াই তারা অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। এর মধ্যে একমি ও হেলথ কেয়ার কারখানা নির্মাণের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে এসব কারখানায় এপিআই উৎপাদন শুরু করা যাবে।
এপিআই হলো ওষুধের মূল উপাদান। যে প্রতিষ্ঠান তা উদ্ভাবন করে সাধারণত তাতে তাদের মেধাস্বত্ব তৈরি হয়। উদ্ভাবনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল আনতে রয়্যালিটি ফি দিতে হয়। বর্তমানে স্বল্পন্নোত দেশের সুবিধায় ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি পেটেন্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশকে কোনো রয়্যালিটি বা কোনো ধরনের ফি দিতে হয় না।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার 'বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাস্বত্ব'(ট্রিপস) আইনে বাংলাদেশকে এ পেটেন্ট করার অধিকার দেয়া রয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই) এর তথ্যমতে, বর্তমানে স্থানীয় কোম্পানিগুলো চাহিদার মাত্র ৩ শতাংশ এপিআই উৎপাদন করতে পারে। ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের ৯৭ শতাংই আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাঁচ বছর পর ২০২৬ সালে যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাবে, তখন এ সুবিধা আর থাকবে না। এতে করে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রয়্যালটি বা ফি দিতে হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে ওষুধের।
তবে তার আগেই নিজেরা ওষুধের ইনগ্রেডিয়েন্ট উদ্ভাবনে যাবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিএপিআই এর মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ওষুধ উৎপাদনের মতোই কাঁচামাল উৎপাদনেও স্বয়ংস্বম্পূর্ণ হওয়ার দিকে যাচ্ছি আমরা। আগামী বছর থেকেই শিল্প পার্কে দু একটি কারখানা উৎপাদন শুরু করতে পারবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সব কারখানায়ই এপিআই উৎপাদনে যেতে পারবে।
অবকাঠামো শেষ করেছে সরকার
দেশীয় ওষুধশিল্পের প্রসার, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি করতে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, ওষুধের মান উন্নয়নে গবেষণা করা এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনে ২০০৮ সালে এপিআই শিল্প পার্ক গড়ে তুলার সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে একটি প্রকল্প 'একনেকে' অনুমোদন দেয়া হয়। দীর্ঘ এক যুগ এর নির্মাণ কাজ শেষ করেছে সরকার।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া নির্মাণাধীন ওষুধ শিল্প পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, ২০০ একর জমিতে নির্মিত শিল্প পার্কটিতে এরই মধ্যে অবকাঠামো যেমন-উন্নত প্লট, মাটি ভরাট, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, ড্রেনের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশন লাইন, বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন, বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, পানি সরবরাহের প্রধান ও সাব লাইন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইপিটি) নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ দিকে।
স্কয়ার, বেক্সিমকো, ইনসেপ্টা, একমিসহ মোট ২৭টি কোম্পানিকে এরই মধ্যে প্লট বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এতে প্রতিটি কোম্পানির জন্য সর্বোচ্চ ১০ একর ও সর্বনিম্ন ৫ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ভবন নির্মাণ কাজও শুরু করেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রতি একর জমির বিনিময়ে প্রাথমিকভাবে ২ কোটি টাকা করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
প্রকল্প পরিচারক শহিদুল ইসলাম বলেন, এই বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইপিটি) একটি অংশের কাজ শেষ হবে। বরাদ্দ নেয়া কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে আগামী জানুয়ারি থেকে শিল্পপার্কে কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করতে পারবে।
কোম্পানিগুলোর প্রস্তুতি
এপিআই শিল্প পার্কে কারখানা স্থাপনে সবচেয়ে এগিয়ে একমি ল্যাবলেটরিজ লিমিটেড। ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভবনের চারতলা পর্যন্ত কাজ শেষ করেছে। ২০২২ সালের জুনে উৎপাদন শুরু করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে ওষুধ উৎপাদনকারী শীর্ষ তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানটি।
একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান সিনহা বলেন, আমাদের ভবন নির্মাণের কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। ক্যাপিটাল মেশিনারিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আরো কিছুদিন লাগবে। তবে ২০২২ সালের জুনে উৎপাদন শুরু করতে পারবো।
এছাড়া ভবন নির্মাণ শুরু করেছে হেলথকেয়ার, ইউনিহেল্থ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
এপিআইতে কারখানা স্থাপনের জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি করছে দেশের ওষুধ খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে সর্বোচ্চ তিনটি প্লট নিয়েছে তারা। যদি বর্তমানে তারা বিদ্যমান কারখানাতেই বর্তমানে ১৫-১৬টি মোলিকুলার উৎপাদন করছে। আগামী বছরের শুরু থেকে এপিআইতে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করবে তারা।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সিএফও জাহাঙ্গীর আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এপিআইতে বিনিয়োগের জন্য আমরা প্রাথমিক ফিজিবিলিটি সম্পন্ন করেছি। শিগগিরিই ওখানে আমাদের কনস্ট্রাকশন কাজ শুরু হবে। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়ায় বিনিয়োগের পরিমাণ বলায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এপিআইতে দুটি প্লট নিয়েছে আরেক শীর্ষ প্রতিষ্ঠান অপসোনিন ফার্মা। আগামী বছরের শুরু থেকেই বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে এই প্রতিষ্ঠানও।
অপসোনিন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রউফ খান বলেন, এপিআই উৎপাদনকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে কোম্পানির বিদ্যমান কারখানা সংস্কারের কাজ চলমান থাকায় এখনই এপিআই পার্কে বিনিয়োগে নামতে পারছি না। আগামী বছর শুরু করা যাবে।
স্কয়ার, অপসোনিনের মতোই আগামী বছর থেকে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরুর পরিকল্পনা করছে বেক্সিমকোসহ প্রায় সবগুলো কোম্পানি।
সৈয়দ শহিদুল ইসলাম বলেন, হেলথকেয়ার এবং এসিআই লিমিটেডের কারখানার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। বাকী প্রতিষ্ঠানগুলোও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আগামী বছর প্রায় সবাই কারখানার কাজ শুরু করবে।
এপিআই উৎপাদনে কর অবকাশ সুবিধা
স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল ও ল্যাবরেটরি স্থাপনে এপিআই শিল্প পার্ককে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ন্যাশনাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) নীতিমালার আলোকেই এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
কোনো প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করার পর ১০ বছরের জন্য এ সুবিধা পাবে। এর আওতায় ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনকারীরা শতভাগ করপোরেট কর মওকুফসহ অন্যান্য কর সুবিধা ভোগ করবেন।