মার্কিন ফেডারেল আদালতে প্রথম মুসলিম বিচারপতি নিয়োগ ও কিছু কথা
মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় জাহিদ কুরেশ নামক প্রথম একজন মুসলিম এক বিচারক মনোনীত হয়েছেন। মার্কিন ফেডারেল বিচার ব্যবস্থায় বিচারকের কার্যকাল তার স্বেচ্ছাধীন অর্থাৎ তিনি যতদিন চাইবেন ততোদিন। একজন বিচারক আমৃত্যু বিচারক পদে থাকতে পারেন। তবে এখন ৭০ বছর বয়স পূর্ণ হলে বিচারক স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার প্রথা চালু হয়েছে।
ফেডারেল কাঠামোর বিচার ব্যবস্থায় বিচারক নিয়োগের পর একমাত্র ইম্পিচমেন্ট ছাড়া কাউকে অপসারণ করা যায় না। বিচারকের বিরুদ্ধে যদি কোন দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয় তাহলে, অভিযোগটি প্রথমে প্রতিনিধি সভায় তারপর সিনেটে পাস হতে হয়। তবে এক্ষেত্রে অভিযুক্ত বিচারকের বক্তব্য শোনার বিধান আছে সিনেটের সামনে। তারপরে উভয়কক্ষের দুই তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন হয় কোনো বিচারককে অপসারণ করতে হলে।
সদ্য নিয়োগ পাওয়া জাহিদ কুরেশি জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক। পিতা-মাতা পাকিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম এই মুসলিম যাকে মনোনয়ন দেওয়া হলো ফেডারেল বিচারক হিসেবে। বিষয়টি বিশ্বের নজর কেড়েছে। মার্কিন রাজনীতিতে দীর্ঘকাল যাবৎ ইহুদি সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রভাব। ধারণা করা হচ্ছিল, এই ধরনের পদগুলোতে মুসলিমদেরকে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ইহুদিরা বাধার সৃষ্টি করছেন ।
৪৬ বছর বয়সী বিচারক জাহিদ কুরেশি আইনের ছাত্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পড়াশোনা শেষ করেছেন এবং দীর্ঘদিন আইনজীবী হিসেবে কাজ করছিলেন। গত ১০ জুন '২১ জো বাইডেনের মনোনীত বিচারক জাহিদ কুরেশির নিয়োগ সিনেটের ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের ব্যাপক সমর্থনে অনুমোদন লাভ করে। ৮১-১৬ ভোটে অনুমোদন পাওয়া কুরেশিকে নিউ জার্সির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফেডারেল বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন জো বাইডেন। এর আগে এই রাজ্যেই জাহিদ কুরেশি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কাজ করতে সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালত সুপ্রিম আদালতের এক ধাপ নিচে।
সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আমাদের দেশের আইন মন্ত্রণালয়ের মতই সম্ভাব্য বিচারকের নামের প্রস্তাব উত্থাপন করে প্রেসিডেন্টের কাছে। প্রেসিডেন্ট বাছাই চুড়ান্ত করে সিনেটের অনুমোদনের জন্য পাঠায়। সিনেট কমিটির সামনে বিচারকের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদেরকে বিভিন্নভাবে যাচাই বাছাই করা করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়। বিচারক নিয়োগের এমন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কালে সবচেয়ে বেশি বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ২৭০ জন ফেডারেল বিচারক নিয়োগ দিয়েছিল, ট্রাম্পের আগের দুই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও প্রেসিডেন্ট বুশ তাদের সময়ে কেউ এত বেশি সংখ্যক বিচারক নিয়োগ দেননি। এই নিয়োগগুলোতে দলীয় বিবেচনা প্রাধন্য পায়। মার্কিন আইনে বিচারকের যোগ্যতা সুনির্দিষ্ট না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনাই শেষ কথা বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে।
জো বাইডেনের বিজয় অর্জনের পর মজার কতগুলো ঘটনা ঘটে। প্রায় ২৫ জন বিচারক তাদের অবসর ঘোষণা করেন। যার মধ্যে ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান শাসন আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরা রয়েছেন। এই অবসর নিয়েও অনেক আলোচনা হচ্ছে। রিপাবলিকান সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা কেনো ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় অবসরে গেলেন না?
ধারণা করা হয়, ট্রাম্পের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে এই বিচারকরা খুশি ছিলেন না। শূন্য পদগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসন বিতর্কিতদের নিয়োগ দিতে পারেন, সে চিন্তা থেকেও বিচারকগণ তাদের অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত অপেক্ষায় রেখেছিলেন। গত জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৫০ টি বিচারক পদ এবং তিনটি আপিল আসন খালি থাকা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন কী কারণে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো ত্বরান্বিত করেননি তা ভাববার বিষয়।
জো বাইডেনের ফেডারেল বিচার কাঠামোতে একজন পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত মুসলিম মনোনয়ন বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে এক নতুন সংকেত, বিশেষ করে আফগান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে ভূখণ্ডটি তালেবানদের কাছে এক প্রকার 'হস্তান্তর' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এমন সময়ে। আফগানিস্তানের বর্তমান প্রশাসন মার্কিনদের সৈন্য প্রত্যাহার সিদ্ধান্তের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তালেবানরা দেশটির নানা শহর যখন একের পর এক দখল করে নিচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই এই মুসলিম বিচারক নিয়োগ কী নতুন কোন সংকেত দিচ্ছে?
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর একজন মুসলিম নারী বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন রাজ্য বিচার বিভাগ পর্যায়ে। রাফিয়া আরশাদ মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় যে কোনো পর্যায়ের প্রথম নারী যিনি হিজাব ব্যবহার করেন। রাফিয়া আরশাদ বিচারক হিসাবে টেক্সাস রাজ্য বিচার ব্যবস্থায় মনোনয়ন লাভ করেছেন। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যেটি রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য। মার্কিন সমাজে ৯/১১ এর পর থেকে ধারাবাহিক মুসলিম বিদ্বেষের নানাবিধ ঘটনার মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ সামাজিক বিভেদ সৃষ্টিকারীদের জন্য বিশেষ 'বার্তা' বলে মনে করা হয়। দীর্ঘদিন যাবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের প্রতি বৈষম্যে অভিযোগ করে আসছিল।
নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকগণ শপথ গ্রহণের মাধমে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বিচারকগণ মার্কিন আইন ও সংবিধান সমুন্নত রাখার যে অঙ্গীকার করেন তা রক্ষার চেষ্টা করেন। ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখি। সাত মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞায় প্রেসিডেন্টের বিতর্কিত নির্বাহী আদেশ সিয়াটলের একটি আদালত সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়। সিয়াটলের বিচারক জেমস রবার্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সাময়িকভাবে স্থগিত করে যে আদেশ দিয়েছেন, তা সারাদেশে কার্যকর হবে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক ফেডারেল আদালত ট্রাম্পের ওই আদেশে স্থগিতাদেশ জারি করেন। তবে প্রথমবারের মতো সিয়াটলের আদালত সারা দেশে ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা সাময়িক স্থগিত করলেন। গত নির্বাচনে পরাজয়ের পর জো বাইডেনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ট্রাম্প এবং তার প্রশাসন একাধিকবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত করে পুনঃগণনার প্রত্যাশায়। ট্রাম্পের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় এবং দায়িত্ব হস্তান্তরে বাধ্য হন।
এরকম উদাহরণ ট্রাম্প সময়ে অহরহ রয়েছে। মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় আদালতের বহু সিদ্ধান্ত নিয়োগ প্রদানকারি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গিয়েছে। তা কেবল ট্রাম্প নয়, প্রায় সকল প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আইনের শাসনের মূল সুরটি এখানে। আদালত এই নিরপেক্ষতা দেখাতে পারলেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা পায়। তবে কাজটি সহজ নয়।
আমাদের উপমহাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে এখনো নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে এগুতে হয়। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভীষণভাবে বিভক্ত এবং সংঘাতময়। ক্ষমতাসীন দল প্রায় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে বিচারব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে চায়। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রনে রাখতে নানা ধরনের চাপ, হুমকি এবং প্রলোভন সবই থাকে। যা উপেক্ষা করা সকল সময় সম্ভব হয়ে উঠে না।
ভারতের বাবরি মসজিদ রায়, গুজরাটের দাঙ্গার অভিযোগ খেকে ক্ষমতাসীনদের অব্যাহতি, পাকিস্তানে শরীয়া আইনের সাথে প্রচলিত আইনের দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা, একাধিক সরকার বরখাস্তের ঘটনা সাধারণের মনে বিরূপ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ন্যায় বিচার বিঘ্নিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। আমাদের দেশে আজও বিচারক নিয়োগের কোন নীতিমালা তৈরি হয়নি। যদিও আমাদের হাইকোর্ট বিচারক নিয়োগের নীতিমালা তৈরির দাবিতে উত্থাপিত একটি রিট মামলার শুনানির ক্ষেত্রে একটি দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে একাধিকবার আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের অঙ্গীকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলা যেতে পারে।